বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৩:৩৭ অপরাহ্ন

আধুনিক পদ্ধতিতে টমেটো চাষ ও ফলন বৃদ্ধি

  • লাস্ট আপডেট : মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭
  • ১২০ টাইম ভিউ
WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

পুষ্টিমানঃ

টমেটো একটি অতি প্রয়োজনীয়, জনপ্রিয় এবং পুষ্টিকর সবজি। এটি ভিটামিন এ এবং সি-এর অন্যতম উৎস। কাঁচা ও রান্না করে-এ দুইভাবেই টমেটো খাওয়া যায়। টমেটো বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয় যেমন জ্যাম, জেলি, সস্, কেচাপ, আচার, সালাদ ইত্যাদি। টমেটোর পুষ্টিমান পাকা টমেটোর ভক্ষণযোগ্য অংশের প্রতি ১০০ গ্রামে পুষ্টি উপাদানসমূহ নিম্ন লিখিত পরিমাণে পাওয়া যায়;

টমেটো চাষের জন্য জলবায়ুঃ

টমেটো এদেশে রবি বা শীতের ফসল হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট  থেকে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। রাতের তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর নিচে থাকলে তা গাছের ফুল ও ফল ধারণের জন্য বেশি উপযোগী। গড় তাপমাত্রা ২০-২৫ ডিগ্রি সে. টমেটোর ভালো ফলনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। রাতের তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর কম হলে টমেটোতে ফল হয় না।

মাটির বৈশিষ্ট্যঃ

আলো-বাতাসযুক্ত উর্বর দো-আঁশ মাটি টমেটো চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা বেলে দো-আঁশ থেকে এঁটেল দো-আঁশ সব মাটিতেই টমেটোর ভালো জন্মে। মাটির অম্লতা ৬-৭ হলে ভালো হয়। মাটির অম্লতা বেশি হলে জমিতে চুন প্রয়োগ করা দরকার।

চাষের মৌসুমঃ

টমেটো দীর্ঘমেয়াদী একটি ফসল। বীজ বোনা থেকে শুরু করে গাছের প্রথম ফল পাকা পর্যন্ত কমপক্ষে ১০০ দিন লাগে এবং ফলধারণ জাতভেদে ৩০-৬০ দিন স্থায়ী হয়। এ জন্য রবি মৌসুমের অনুকূল আবহাওয়ার সম্পূর্ণ সুযোগ নিতে হলে মৌসুম আসার আগেই চাষের আয়োজন করতে হবে।

#    বর্ষাকালের চাষের জন্য এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত এবং আগাম জাতের ক্ষেত্রে জুলাই থেকে আগস্ট মাস এবং শীতকালীন চাষের জন্য সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় বীজ বপন করা যায়।

বীজতলা তৈরিঃ

চারা তৈরির দুই মাস আগে বীজ বপনের জন্য বীজতলা তৈরির প্রস্তুতি নিতে হবে। বীজতলায় নির্দিষ্ট পরিমাণ জৈব সার এবং নি¤œলিখিত অন্যান্য সার এবং রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করতে হবে।

বীজতলায় বীজ বপনঃ

বীজ বোনার আগে  প্রোভক্স/ব্যাভিস্টিন বা ভিটাভ্যাক্স বা সিনকার দ্বারা বীজ শোধন করে নিতে হবে। সুস্থ সবল চারা উৎপাদনের জন্য প্রথমে ১০ গ্রাম মানসম্মত ভাল বীজ ঘন করে প্রতিটি বীজতলায় (বীজ তলার আয়তন হবে দৈর্ঘ্য ১ মিটার ও প্রস্থ ৩ মিটার) বুনতে হয়।এই হিসেবে প্রতি হেক্টরে (প্রায় ২৫০ শতক)) ২০০ গ্রাম (১ গ্রাম/শতাংশ) বীজ বুনতে (গজানোর হার ৮০%) ২০টি বীজতলার প্রয়োজন।

 

গজানোর ৮-১০ দিন পর চারা দ্বিতীয় বীজতলায় প্রতিটি চারা ৪ সেমি. দূরত্বে স্থানান্তর বা রোপণ করতে পারলে ভালো হয়।এক হেক্টর জমিতে টমেটো চাষের জন্য এ রকম ২০-২২টি বীজতলার প্রয়োজন হয়।বীজতলায় প্রতি ইঞ্চিতে ৪০-৬০টি ছিদ্রযুক্ত নাইলন নেট দিয়ে ঢেকে চারা উৎপাদন করলে চারা অবস্থায়ই সাদা মাছিপোকার কারণে পাতা কোঁকড়ানো ভাইরাস রোগ ছড়ানোর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। এ রকম সুস্থ সবল ও ভাইরাসমুক্ত চারা রোপণ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়।অতিরিক্ত বৃষ্টি ও রোদের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে পলিথিন ও চাটাই এর আচ্ছাদন ব্যবহার করা দরকার ।

আরও পড়ুন  জুমচাষ পদ্ধতি

বীজের পরিমাণঃ

বীজতলায় বীজ বপনের ক্ষেত্রে শতাংশ জমি প্রতি ১ গ্রাম (২০০ গ্রাম/হেক্টর) বীজ লাগে। তবে জাত ভেদে বীজের পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে।

মূল জমি তৈরিঃ

জমি ভালভাবে চাষ দিয়ে বেড তৈরি করে নিতে হবে।

সারের পরিমাণ ও প্রয়োগঃ

টমেটো গাছ মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন গ্রহণ করে। বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে খাদ্যের অভাব হলে গাছ দ্রুত বাড়ে না এবং পরবর্তী পর্যায়ে খাদ্যের ঘাটতি ফলণ অনেক কমিয়ে দেয়। মাটি পরীক্ষা করে জমির চাহিদা অনুযায়ী সার প্রয়োগ করাই সবচেয়ে ভাল। তবে গড়পড়তায় টমেটো চাষের জন্য প্রতি শতাংশ জমিতে যে সারের দরকার হয় তা হলোঃ

সার প্রয়োগ পদ্ধতিঃ

ইউরিয়া ও এমওপি সার ব্যতীত বাকি সব সার মূলজমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে এবং মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে ফেলতে হবে। তবে দস্তা ও টিএসপি এক সাথে প্রয়োগ করা উচিত নয়। ইউরিয়া ও এমওপি সার সমান তিন ভাগে ভাগ করে তিনবারে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম ভাগ চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর, দ্বিতীয় ভাগ চারা রোপণের ২৫-৩০ দিন পর, তৃতীয় ভাগ চারা রোপণের ৪০-৪৫ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

চারা রোপণঃ

চারার বয়স ২৫-৩০ দিন অথবা ৪-৬ পাতা হলে মূল জমিতে রোপণ করতে হবে।বীজতলা থেকে চারা অত্যন্ত যতœ সহকারে তুলতে হবে যাতে চারা শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এ জন্য চারা তোলার আগে বীজতলার মাটি ভিজিয়ে নিতে হবে।

 

চারা রোপণের আগে উপড়ে তোলা চারাগাছটির গোড়া (শিকড়) ২% ইউরিয়া +২% বোরিক এসিড দ্রবণে ডুবিয়ে নিলে চারা গাছটি তাৎক্ষণিকভাবে খাবার পায়। ফলে পাতা হলুদ বা বিবর্ণ হবে না।প্রথমে ১ মিটার চওড়া বেড তৈরি করে নিতে হবে। প্রতি বেডে দুই লাইন করে চারা রোপণ করতে হবে। লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব হবে ৬০ সেমি. এবং প্রতি লাইনে চারা থেকে চারা ৬০ সেমি. দূরত্বে লাগাতে হবে।একটি বেডে দুই লাইনে টমেটোর চারা রোপণ করার ক্ষেত্রে চারাগুলো ত্রিভূজ আকৃতিতে লাগাতে হবে।বিকেলের পড়ন্ত রোদে চারা রোপণ করাই উত্তম এবং লাগানোর পর গোড়ায় হালকা সেচ প্রদান করতে হবে।

আরও পড়ুন  কচুর লতির চাষ পদ্ধতি

সেচ ও নিষ্কাশনঃ

চারা রোপণের ৩-৪ দিন পর পর্যন্ত হালকা সেচ ও পরে প্রতি কিস্তিতে সার উপরি প্রয়োগের পর জমিতে সেচ দিতে হয়। গ্রীষ্ম মৌসুমে টমেটো চাষের জন্য ঘন ঘন সেচের প্রয়োজন হয়। বর্ষা মৌসুমে তেমন একটা সেচের প্রয়োজন হয় না। টমেটো গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।

 

সেচ অথবা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য নালা পরিমিতি চওড়া (৩০-৪০ সেন্টিমিটার) এবং এক দিকে সামান্য ঢালু হওয়া দরকার। সেচ দেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, সেচের পানি কখনোই যেন বেডের উপর উঠে না আসে। নালাতে সেচ দিতে হবে, নালা থেকে শোষণের মাধ্যমে বেড ও গাছ পানি সংগ্রহ করতে হবে।

আচ্ছাদনের ব্যবস্থাঃ  সূর্যের প্রখরতা থেকে চারা গাছকে বাঁচানোর জন্য ছায়াদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

মালচিংঃ প্রতিটি সেচের পরে মাটির উপরি ভাগের চটা বা চাকামাটি ভেঙে দিতে হবে যাতে মাটিতে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে।

আগাছা দমনঃ টমেটোর জমিতে প্রয়োজনীয় নিড়ানি দিয়ে আগাছামুক্ত রাখতে হবে।

বিশেষ পরিচর্যাঃ 

#   প্রথম ফুলের গোছার ঠিক নিচের কুশিটি ছাড়া নিচের সব পার্শ্বকুশি ছেঁেট দিতে হবে।

#   বাউনিয়া দেয়া-গাছে বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঠেকনা দিতে হবে।

ফসল তোলাঃ

#    ফলের নিচে ফুল ঝরে যাওয়ার পর যে দাগ থাকে ঐ স্থান থেকে লালচে ভাব শুরু হলেই বাজারজাতকরণের জন্য ফল সংগ্রহ করতে হবে। এতে ফল অনেকদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।

#    অপরিপক্ব অবস্থায় ফল তুলে হরমোন প্রয়োগে ফল পাকানো হলে ফলের স্বাভাবিক স্বাদ ও পুষ্টিগুণ নষ্ট হয় এবং ফলনও কম হয়। তাই এভাবে ফলন সংগ্রহ ও পাকানো মোটেই সমীচিন নয়।

মেয়াদঃ ১০০-১৪০ দিন।

ফলনঃ জাত ভেদে ফলন ১৫-৫০ টন/একর হয়। মৌসুম, জাত, আবহাওয়া এবং পরিচর্যা অনুযায়ী প্রতি একর জমিতে ৫০ টনের বেশি টমেটো পাওয়া সম্ভব।

টমেটোর জাতঃ

মৌসুম অনুযায়ী এ দেশে চাষযোগ্য টমেটো জাতসমূহকে মোটামুটিভাবে নিম্নলিখিত শ্রেণীসমূহে ভাগ করা যেতে পারে:

আগাম জাতঃ এসব জাত শীতকালেই হয়, তবে আগাম ফলে। আগাম জাতসমূহের বীজ বপন করা হয় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে। আগাম জাতসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বারি টমেটো ৪, বারি টমেটো ৫, রোমা ভিএফ, রোমারিও, টিপু সুলতান, গ্রেট পেলে, ডেল্টা এফ ১, উন্নয়ন এফ ১, পুষারুবী, নিউ রূপালী এফ ১ ইত্যাদি।

আরও পড়ুন  নেপিয়ার ঘাসের চাষ পদ্ধতি

ভরা মৌসুমী জাতঃ শীতকালে স্বাভাবিক সময়েই এসব জাতের গাছে ফল ধরে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বীজ বুনে অক্টোবর-নভেম্বরে এসব জাতের টমেটোর চারা রোপণ করা হয়। অধিকাংশ জাতই শীতকালে ফলে। এসব জাতের মধ্য থেকে মানিক, রতন, বারি টমেটো ৩, বারি টমেটো ৬, বারি টমেটো ৭, বারি টমেটো ৯, বাহার, মহুয়া ইত্যাদি জাতকে বেছে নেয়া যেতে পারে।

নাবি শীত মৌসুমী জাতঃ এসব জাতের বীজ বুনতে হয় জানুয়ারিতে, ফল পাওয়া যায় মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত। বাহার, রোমা ভিএফ, রাজা, সুরক্ষা ইত্যাদি জাত নাবি চাষের জন্য ভাল।

সারা বছর চাষের উপযোগি জাতঃ বছরের যে কোন সময় টমেটোর বীজ বুনলে চারা ও সেসব চারা লাগালে গাছ হয় সত্য, এমনকি সেসব গাছে ফুলও আসে। কিন্তু সব জাতের গাছে ফল ধরে না। এজন্য সারা বছর চাষের উপযোগি জাত যেমন বারি টমেটো ৬ (চৈতী) চাষ করা যায়।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা উদ্ভাবিত টমেটোর উন্মুক্ত (OP) জাত গুলির সংক্ষিপ্ত বৈশিষ্ট নিম্নে দেয়া হলো:

গ্রীষ্ম ও বর্ষায় চাষ পদ্ধতি:

গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে টমেটো চাষ করার জন্য বারি-৪ হাইব্রিড টমেটো জাত অনুমোদন করা হয়েছে।২৩০ সেন্টিমিটার (প্রায় ৯০ ইঞ্চি) চওড়া (মাঝে ৩০ সেন্টিমিটার নালাসহ) ২টি বেডে লম্বালম্বিভাবে একটি করে ছাউনির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ছাউনির দু’পাশে উচ্চতা ১৩৫ সেন্টিমিটার ও মাঝখানের উচ্চতা ১৮০ সেন্টিমিটার হয়।চারা লাগানোর আগেই জমিতে নৌকার ছইয়ের আকৃতি করে ছাউনি দিতে হয়। ছাউনির জন্য বাঁশ, স্বচ্ছ পলিথিন, নাইলনের দড়ি ও পাটের সুতলি প্রয়োজন।

 

পলিথিন যাতে বাতাসে উড়ে না যায় সেজন্য ছাউনির ওপর দিয়ে উভয় পাশ থেকে আড়াআড়িভাবে দড়ি পেঁচানো হয়ে থাকে।পাশাপাশি দুই ছাউনির মাঝে ৫০ সেন্টিমিটার চওড়া নিষ্কাশন নালা রাখতে হবে। জমি থেকে বেডের উচ্চতা ২০-২৫ সেন্টিমিটার হতে হবে। প্রতিটি ছাউনিতে ২টি বেডে ৪টি সারি থাকবে। ২৫-৩০ দিন বয়সের চারা প্রতি বেডে ২ সারি করে রোপণ করতে হবে।গ্রীষ্মকালীন টমেটো গাছে প্রচুর ফুল ও করলেও উচ্চ তাপমাত্রা পরাগায়নে বিঘœ ঘটায়। কাজেই আশানুরূপ ফলন পেতে হলে ‘টমাটোটোন’ নামক কৃত্রিম হরমোন ২ সেমি. ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ছোট সিঞ্চনযন্ত্রের সাহায্যে সপ্তাহে দুইবার শুধুমাত্র সদ্য ফোটা ফুলে স্প্রে করতে হবে।তবে নতুন উদ্ভাবিত হাইব্রিড জাতসমূহের হরমোন প্রয়োগ ছাড়াও লাভজনক ফলন পাওয়া যায়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে দিন

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
একই রকম পোস্ট