ছাদে আম গাছ চাষ

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

ছাদে আম গাছ চাষ

ঢাকার মণিপুরীপাড়ায় একটি চার তলার বাড়ির ছাদে কয়েকটা আমগাছ লাগিয়ে বাগান করেছেন দেওয়ান মজিবুর রহমান। বোশেখ মাস। প্রায় প্রতিটা আমগাছেই কিছু না কিছু আম ঝুলছে। একটা গাছের আম হলদে হয়ে পাক ধরেছে। বারোমাসি জাত, তাই অসময়েও আম ধরে, অসময়ে পাকে। এসব দেখে মজিবুর রহমান বেশ আনন্দ পান।

 বারোমাসি জাত ছাড়াও তার ছাদবাগানে আছে আম্রপালি, হিমসাগর, খিরসাপাত, মলি্লকা ও গোপালভোগ জাতের মোট ২০টি আম গাছ। সব গাছ তিনি লাগিয়েছেন হাফ ড্রামে। প্রতিবছর এ ২০টি আমগাছ থেকে যে পরিমাণ আম হয় তাতে পরিবারের খাওয়ার কাজ চলে যায়। বছরভেদে তিনি গাছগুলো থেকে প্রায় ২০০-৪০০টি আম পান। তিনি এই ভেবে খুশি, যাই হোক বাজার থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক দিয়ে পাকানো খারাপ আম তো কিনে খেতে হচ্ছে না। পরিশ্রম আর খরচ যাই-ই হোক, বাগান করে দেহ-মনের স্বাস্থ্য তো ভালো রাখা যাচ্ছে।

প্রায় ১০ বছর আগে তার ছাদবাগানের যাত্রা শুরু। বৃক্ষমেলায় গিয়ে একটি টবের আমগাছে পাকা আম ঝুলতে দেখে শখ হয় টবে আম চাষ করার। সেই গাছটি কিনে এনে একটা হাফ ড্রামে লাগিয়ে দেন। পরের বছরও সে গাছে আম ধরে। এরপর তিনি একের পর এক বাড়িয়ে তোলেন আমসহ অন্যান্য ফলগাছের বাগান। আম ছাড়া এখন তার ছাদবাগানে আছে জামরুল, পেয়ারা, বিলিম্বি, কুল ও সফেদা গাছ। মাঝেমধ্যে তিনি ছাদবাগানের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঢাকা অফিসের উপপরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম ও উপসহকারী কৃষি অফিসার রঞ্জিতা খানমের পরামর্শ নেন। তারা তার বাগানও মাঝেমধ্যে পরিদর্শন করেন। তাদের পরামর্শ ও নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি রোজ বাগানের পরিচর্যা করেন। ফলগাছের ভালো বাড়বাড়তি ও ফলধারণের জন্য তিনি গোবর সারের পাশাপাশি ট্যাবলেট সার দিয়ে ভালো ফল পেয়েছেন। আট বছর বয়সী গাছের জন্য ৮টি ও ১০ বছর বয়সী গাছের জন্য ১০টি করে এক একটি গাছে বছরে একবার ট্যাবলেট সার দিয়েছেন। নিয়মিত পানিও দিতে হয়। পোকার জন্য মুকুল আসার ঠিক আগে একবার ও গুটি দাঁড়ানোর পর কীটনাশকও স্প্রে করতে হয়। তিনি বলেন, ছাদে বাগান করে যত্ন করতে ঠিকই বেশ সময় দিতে হয়। তারপরও তিনি মনে করেন, প্রত্যেকেরই বাড়ি করার আগে নকশা ও পরিকল্পনার সময়ই ছাদে কিছু গাছপালা লাগানোর পরিকল্পনা রাখা বাধ্যতামূলক করা উচিত। নগরীর পরিবেশ রক্ষায় এটা খুবই জরুরি।

আরও পড়ুন   হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ পদ্ধতি ও স্থাপনা নির্মাণ কৌশল

ছাদে আমবাগান করার কৌশল:

আমগাছ খুব বড় হয়। তাই যে কোনো আমগাছ ড্রামে লাগানো যাবে না। ড্রামে লাগানোর জন্য বেছে নিতে হবে এমন সব আমের জাত যেগুলোর গাছ খাটো বা বামন ও ঝোপালো হয় এবং অল্প বয়স থেকেই আম দেয়া শুরু করে। এ দেশে প্রাপ্ত জাতগুলোর মধ্যে আম্রপালি, লতা বোম্বাই, মলি্লকা, নিলম, দশেরি, চৌষা, কেইট, শ্রাবণী, সিন্দুরী, বাউ আম-৩, বাউ আম-৭, বাউ আম-৯ (চৌফলা) ইত্যাদি জাত ড্রামে লাগাতে পারেন। আম্রপালি জাতের আম খুব মিষ্টি ও বেশ কয়েকদিন ঘরে রেখে খাওয়া যায়, গাছে ধরেও প্রচুর। বাউ আম-৯ জাতটি নিয়মিত ফলধারী বামন প্রকৃতির গাছ, এ গাছে বছরে ৩-৪ বার আম ধরে। তাই সৌখিন ফলচাষিরা ছাদে ড্রামে বা টবে এ জাতটি চাষ করতে পারেন। বাণিজ্যিকভাবে এটা চাষ না করা ভালো। এছাড়া থাইল্যান্ড থেকে আসা ‘নাম ডক মাই’ জাতটিও ড্রামে লাগাতে পারেন। আশপাশের বিশ্বস্ত নার্সারি বা সরকারি হর্টিকালচার সেন্টারগুলো থেকে এসব জাতের কলম কিনতে পারেন।

মে-জুনে ড্রামে আমের কলম লাগানোর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। হাফ ড্রাম হলে ভালো হয়। ড্রামের জন্য সার মাটি তৈরি করতে হবে। টবের জন্য দো-অাঁশ মাটি নেবেন। মাটির সঙ্গে চার ভাগের এক ভাগ বা ১০ কেজি গোবর সার বা ড্রামপ্রতি ৪ কেজি প্যাকেটের কম্পোস্ট সার, ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম এমওপি (পটাশ) সার, ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম টিএসপি (ফসফেট) সার, ১ কেজি হাঁড়ের গুঁড়ো, ৫০ গ্রাম ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সার মিশিয়ে নিন। এসব সার মাটি ড্রামে ভরার আগে ড্রাম থেকে যাতে অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে যেতে পারে সেজন্য ড্রামের তলায় ছিদ্র করে নিন। ছিদ্রের মুখে তিন দিকে পুরনো মাটির টব ভাঙা টুকরো এমনভাবে দিন যাতে ছিদ্রের মুখ বন্ধ না হয়। এর ওপর আর একটা টুকরো দিয়ে ঢেকে পাতলা স্তর করে খড় বিছিয়ে দিন। তারপর সার মাটি দিয়ে ড্রাম ভরে দিন। ড্রামের মাঝখানে সোজা করে জুন-জুলাই মাসে আমের কলম পুঁতে দিন। কলম লাগানোর পর পানি দেবেন। কলম যদি বেশি লম্বা হয় তাহলে মাটিতে লেগে গেলে আগা কেটে কিছুটা খাটো করে দিতে পারেন। এতে পরে গাছ ভালো ঝোপালো হবে।
জুন-জুলাইয়ে লাগানো কলমের গাছে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে মুকুল আসবে। তবে প্রথম বছর সেসব মুকুল না রেখে সব ভেঙে দেবেন। পরের বছর আসা মুকুল রেখে আম ফলাবেন। প্রতি বছর বর্ষার আগে ও পরে ড্রামের মাটিতে গোবর ও অন্যান্য সার দেবেন। বছরে একবার প্রতি ড্রামে চারটি করে ট্যাবলেট সার পুঁতে দিতে পারেন। ট্যাবলেট সার দিলে শুধু গোবর সার দেবেন, অন্য কোনো সার দেয়ার দরকার হবে না। চার-পাঁচ বছর অন্তর গাছের গোড়া থেকে খানিকটা মাটি সরিয়ে কিছু শিকড় ও ডালপালা ছেঁটে দেবেন। বর্ষার আগে এ কাজ করতে হবে। জুন-জুলাইতে যখন আম তুলবেন, দু’তিনটি পাতাসহ বোঁটা কেটে তুলবেন। এতে পরের বছর ভালো আম ধরবে। মুকুল ও গুটি ঝরা কমাতে প্ল্যানোফিক্স হরমোন মুকুল বের হওয়ার ঠিক আগে ও ঠিক পরে দুবার স্প্রে করতে পারেন। এ সময় ছত্রাকনাশক ও কীটনাশকও ছিটাতে পারেন। গুটি মারবেলের মতো হলে সে সময়ও একবার ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক ছিটাতে পারেন। এতে আমগাছে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হবে। ড্রাম রাখবেন ছাদে খোলা জায়গায় যেখানে সারা দিন রোদ পড়ে। ড্রাম ছাদের ওপর এমনভাবে রাখবেন যাতে ছাদ থেকে ড্রাম কিছুটা উঁচু বা ফাঁকা থাকে। এতে ছাদের ক্ষতি হবে না। এজন্য ড্রামের তলায় চার পাশে চারটি ইট দিয়ে উঁচু করে দিতে পারেন। ড্রামে ৬-৭ বছর গাছ রাখার পর সেটা সরিয়ে নতুন গাছ লাগালে ভালো হয়।

আরও পড়ুন   চুয়াডাঙ্গায় পেয়ারা বাগান করে সফলতা পেয়েছেন চাষীরা

লেখক : কৃষিবিদ মৃত্যুঞ্জয় রায়

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now