আজ মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:০৪ পূর্বাহ্ন

টবে গাছ লাগানোর নিয়ম

টবে গাছ লাগানোর নিয়ম-নীতি

আজকাল অনেকেই টবে বিভিন্ন ফুল, ফল ও শাকসবজি চাষ করে থাকেন। টবে গাছ লাগানোর কিছু নিয়ম-নীতি নিম্নে দেওয়া হলঃ

টবের প্রকার ও প্রস্ততিঃবীজ বুনে চারা উৎপাদনের জন্য চওড়া ও অগভীর টব। মৌসুমী ফুলের জন্য মাঝারী আকৃতির এবং বর্ষজীবী, বহুবর্ষজীবী ও ঝোপ জাতীয় গাছের জন্য বড় আকারের টব প্রয়েজন। মাটির তৈরি কাঠ ,কংক্রিট, সিরামিক এবং প্লাস্টিকের তৈরি টব ব্যবহার করা যেতে পারে।

প্লাস্টিক টব ওজনে হালকা হওয়ায় এটি অনেকই ঝুলানো টব হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। তবে আমাদের দেশে এখনও মাটির টবই বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। কাঠ ও ধাতুর তৈরি টবের দাম বেশি হওয়ায় এর ব্যবহার সীমিত। মাটির টব ভেংগে যায় এবং কাঠের টব পচনশীল বলে কংক্রিটের টব ব্যবহার করা লাভ জনক কারণ দীর্ঘদিন টেকে।

পানি চুয়ানোর জন্য টবেব নিচে ২/১ টি ছিদ্র থাকা প্রয়োজন। তবে জলজ উদ্ভিদের জন্য ব্যবহৃত টবে ছিদ্র না থাকাই ভাল। প্রতি ক্ষেত্রেই ছিদ্রযুক্ত টবেব নিচে ভাঙ্গা চাড়া, নারিকেলের ছোবড়া, খড়কুটা বা ইটের টুকরো দিয়ে বন্ধ করে তার উপর কিছু শুকনো পাতা দিতে হবে। এরপর বেলে মাটি এবং তার উপর সার মাটি দিয়ে টব এমনভাবে ভর্তি করে দিতে হবে যেন ওপরে অন্তত এক ইঞ্চি পরিমাণ খালি থাকে। নতুন কিংবা পুরাতন উভয় প্রকার টবই ব্যবহারের আগে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। এতে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হয।

টবের মাটি কেমন হবেঃ টবে ভাল ফুলগাছ করার জন্য চাই ভাল মাটি। সাধারণভাবে ভাল মাটি বলতে দোঁআশ মাটিকেই বোঝায়। মাটি সংগ্রহের আদর্শ জায়গা হচ্ছে অনাবাদি মাঠ , ক্ষেতের মাটি, পুকুর ও নদীর পাড়। সর্বদাই মাটি নিতে হবে উপর থেকে দেড় ফুট গভীরতা পর্যন্ত। গভীর গর্তের মাটি, পাতকুয়া খোড়া মাটি, পুকুরের তলার পাঁকমাটি, গাছ বসানোর জন্য ভাল নয়। কারণ বেশি নিচের (গভীর জায়গা) মাটি প্রকৃতিতে কঠিন ও গুণে অসার হয়।

আরও পড়ুন   বগুড়াতে বিনাচাষে ধান আবাদে লাভবান কৃষক

উপরকার মাটিতে নানান জৈবিক পদার্থ পচে মিশে থাকে। রৌদ্রকিরণ ও হাওয়া লেগে মাটি ছত্রাক রোগ মুক্ত থাকে। এই সবের জন্যই উপরকার মাটি ভাল। নিচের মাটিতে এই সব সার পদার্থ অধিক পরিমাণে প্রবেশ করতে পারে না।

রোদ হাওয়া না লাগার জন্য নিচের মাটি আঠালো ধরনের হয়। যে সমস্ত জায়গার মাটি টবে ফুল চাষের জন্য ভাল নয় তা হাচ্ছে- নর্দমার মাটি, সারা বছর পানি জমে থাকে এমন জায়গার মাটি ও কারখানার আবর্জনা ফেলা হয় এমন জায়গার মাটি। নর্দমার মাটিতে মাত্রাতিরিক্ত আবর্জনা ও গাছের পক্ষে ক্ষতিকারক দ্রব্যের পরিমাণ বেশি থাকে। পানি জমে থাকা জায়গার মাটি সহজে শুকোয় না আর ছত্রাক জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব সহজে হয়। কারখানার ময়লা ফেলা জমির মাটিতে সব সময় না হলেও কোন কোনো সময় গাছের পক্ষে ক্ষতিকারক বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক দ্রব্যকণা মিশে থাকে যা গাছের পক্ষে ক্ষতিকর।

টবের মাটি তৈরিঃ মাটিকে ভাল করে রোদে শুকিয়ে দশ ইঞ্চি মাপের একশো টব মাটির সঙ্গে পাঁচশো গ্রাম গুঁড়ো চুন মিশিয়ে দশ দিন বাদে চার ভাগের এক ভাগ গোবর সার, পাতা পচা সার বা কম্পোস্ট সারের যে কোনও একটি ও পাঁচ কেজি হাড়ের গুঁড়ো, পাঁচ কেজি শিং-এর গুঁড়ো, এক টব মতো কাঠ ও ঘুঁটে পোড়া ছাই মিশিয়ে দু‘ মাসের বেশি সময় কোন উম্মুক্ত স্থানে রাখতে হবে। এতে সমস্ত জিনিসগুলি মাটির সঙ্গে মিশে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করবে। বেশি বৃষ্টির সময় আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। হাড়ের গুঁড়ো, শিং-এর গুঁড়ো ইত্যাদি জৈবিক সার ভালভাবে মাটির সঙ্গে মিশতে অনেক সময় লাগে।

সদ্য সার মেশানো মাটিতে গাছ বসালে সারের উপকারিতা কম পাওয়া যায় ও অনেক সময় সারের পচনক্রিয়া শুরু হওয়ার ফলে মাটির মধ্যে যে উত্তাপের সৃষ্টি হয় তাতে গাছ মরেও যেতে পারে। মাটি আগে থেকে তৈরি করার আর একটি ভাল দিক হচ্ছে সার পচার সময় যে গরম ভাবের সৃষ্টি হয তার অস্তিত্ব মাটিতে থাকে না। ফলে বসানোর সময় থেকেই গাছ সার গ্রহণে সক্ষম হয়। এই নিয়মে মাটি তৈরি করা হলে কয়েক রকম গাছ ছাড়া প্রায় সব জাতীয় গাছই ভাল হবে।

আরও পড়ুন   ছাদে ব্যাপক ভিত্তিতে জারবেরা চাষ

টবে চারা রোপণঃ এক মাস বয়সের ফুলের চারা বীজতলা থেকে অথবা ছোট টব থেকে স্থানান্তর করে বড় টবে রোপণ করা উচিত। রোপণের সময় চারাগাছের শিকড় চারদিকে প্রসারিত করে আলতোভাবে টব ভর্তি করে দিতে হবে। এরপর আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে মাটি শক্ত করে দিতে হবে, যাতে চারাগাছ হেলে না পড়ে বরং সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

আচ্ছাদন দেয়াঃ সদ্য লাগানো ফুলের চারা কয়েকদিন ছায়ায় রেখে সহনশীল করে নিতে হয়। যদি সম্ভব না হয় তাহলে কলা বা সুপারী গাছের খোল কেটে অথবা অন্য উপায়ে চারাগুলো রৌদ্র থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এ অবস্থায় সকালে-বিকালের রোদ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

গাছের গোড়া খুঁচিয়ে দেওয়াঃ টবে গাছের গোড়ার মাটি একেবারে গুড়ো না করে চাকা চাকা করে খুঁচে দেয়াই ভাল। এক্ষেত্রে মাটি খোঁচানোর গভীরতা হবে ৩-১০ সেঃ মিঃ বা ১ থেকে ৪ ইঞ্চি গভীর। এ কাজটি প্রতি ১০ দিনে একবার করে করতে হবে।

গাছের অবলম্বন ও গাছ বাঁধাঃ গাছকে খাড়া রাখার জন্য অবলম্বনের প্রয়োজন হয়। গাছের চারা অবস্থা থেকেই এ ব্যবস্থা করতে হয়। এ কাজে বাঁশের কঞ্চি ব্যবহার করা হয়। এতে বারবার কঞ্চি ওঠানো বসানোর ফলে গাছ ও শিকড়ের ক্ষতি হতে পারে। তাই চারা অবস্থাতেই এমন অবলম্বন লাগাতে হবে যা আর পল্টানোর প্রয়োজন হবে না। কঞ্চিটিকে গাছের সংগে মিলিয়ে রঙ দিয়ে দিলে আরো ভাল দেখাবে। গাছকে অবলম্বনের সংগে এমনভাবে বাঁধতে হবে যাতে গাছের কোন ক্ষতি না হয়। একটি মোলায়েম দড়ি দিয়ে প্রথমে একদিক অবলম্বনের সংগে বেঁধে অপরদিকে বাংলা ৪ এর মত করে গাছের সংগে আলতোভাবে ঘুরিয়ে বাঁধতে হবে যাতে গাছটি বাতাসে সামান্য নড়তে পারে।

টবে পানি সেচঃ টবে ঝাঁঝরি দিয়ে পানি সেচ দেওয়া ভাল। মাটিতে রস কম থাকলে গাছ বাড়ে না। আবার অতিরিক্ত পানিতে গাছের শিকড় ও গোড়া পচে যায়। চারাগাছ লাগানোর পর পানির অভাবে টবের গাছ শুকিয়ে যায়, তবে বেশি পানি হলে গাছ পচে যেতে পারে।চারা লাগানোর পর এমন পরিমান সেচ দিতে হবে যেন টবের মাটি সাতদিন পর্যন্ত ভেজা থাকে। পানি সেচের জন্য বিকেল বেলাই ভাল। জৈব কিংবা রাসায়নিক সার প্রয়োগের পর এমন পরিমাণ সেচ দিতে হবে যাতে মাটি তিন দিন পর্যন্ত ভেজা থাকে। বর্ষাকালে টব স্যাঁতসেঁতে মাটির উপরে রাখলে তলার ছিদ্র দিয়ে ঠিকমত পানি নিস্কাশন নাও হতে পারে। এজন্য এ সময়ে ৩-৪ ইঞ্চি ফাঁক করে ইট স্থাপন করে তার উপর টব রাখা যেতে পারে।

আরও পড়ুন   মৌমাছি পালন ও মধু চাষ

উপরি সার প্রয়োগঃ টবের মাটি ও খাদ্যোপাদান সীমিত বলে সব টবের গাছেই উপরি সার দেয়ার দরকার হয়। এই উপরি সার টবের চারিদিকে কানা ঘেষে ৬ সেঃ মিঃ গভীর ও ৩ সেঃ মিঃ চওড়া করে মাটি খুঁড়ে সমান হারে দিয়ে আবার মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

গাছ লাগানোর পর থেকে খৈল,মাছ গোবর ইত্যাদি পচা আধা লিটার পানি চার লিটার পানির সাথে মিশিয়ে প্রতি গাছে আধা লিটার করে প্রতি সপ্তাহে একবার করে দিতে হবে।

তরল সার ব্যবহারের সময় গাছের গোড়ার মাটি বেশ ভেজা ভেজা থাকা দরকার। তাই এ সার ব্যবহারের কয়েক ঘন্টা আগে গাছে একবার সেচ দিয়ে নিতে হয। তরল সার দেয়ার পরও একবার সেচ দিলে ভাল হয়।

কুঁড়ি আসার লক্ষণ প্রকাশ পেলে ৫০ গ্রাম টিএসপি ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ২৫ গ্রাম এমপি এক সাথে মিশিয়ে প্রতি গাছে তিন গ্রাম করে সাত দিন অন্তর দিতে হবে। এই রাসায়নিক সার তিন বারের বেশি দেবার দরকার নেই। তবে রাসায়নিক সার ব্যবহারের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন সার কোন ক্রমেই শিকড়ের উপর না পড়ে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে দিন

Comments are closed.

© All rights reserved © 2014 Ajkerkrishi.com