তুলা চাষ পদ্ধতি
অর্থকরী ফসলঃ তুলা
তুলা গাছ থেকে প্রাকৃতিক তন্তু হিসেবে তুলা পাওয়া যায়। এটি একটি অর্থকরী ফসল। জমিতে উৎপাদন করার পর কাপড় তৈরির জন্য এর ফল সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া তুলা গাছের সব অংশই কোন না কোন কাজে লাগে।
কেন তুলা চাষ করবেন
বীজ তুলা হতে ৩৫%-৪০% আঁশ ও ৬০%-৬৫% তুলা বীজ পাওয়া যায়। তুলার আঁশ বস্ত্রকল গুলোতে সুতা তৈরির প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বর্জ্য তুলা (গার্মেন্ট শিল্প ও জুট) লেপ-তোষক ও শতরঞ্চি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। তুলা বীজ হতে তেল ও খৈল পাওয়া যায়। তুলাবীজ থেকে প্রাপ্ত পরিশোধিত তেল ভোজ্যতেল ও অপরিশোধিত তেল সাবান তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তুলা বীজের খৈল গবাদিপশু ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বীজের গায়ে লেগে থাকা আঁশ (Fuzz) পৃথক করার পর এগুলো ব্যান্ডেজ, গজ, ব্লটিং পেপার এবং কটন বাড প্রভৃতি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়।
তুলার বিভিন্ন জাত
সমতল এলাকার জন্য
• উচ্চ ফলনশীল জাতের তুলা: সিবি-৫, সিবি-৯ সিবি-১০ ও সিবি-১১
• হাইব্রিড জাত: হীরা হাইব্রিড রূপালী-১ ও ডিএম-১ জাতের তুলা চাষ হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য
• পাহাড়ি তুলা-১
• পাহাড়ি তুলা-২
কোথায় তুলা চাষ করবেন
তুলা চাষের জন্য উৎকৃষ্ট মাটি হল দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি। তবে পর্যাপ্ত জৈব পদার্থ রয়েছে এমন মাটিতেই তুলার চাষ করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। খুব বেশি বেলে বা কর্দমকণা সমৃদ্ধ মাটি তুলা চাষের জন্য উপযুক্ত নয়। যেসব জমিতে বৃষ্টির পানি দাঁড়িয়ে থাকে না বা স্বাভাবিক বন্যার পানি উঠে না এরূপ জমি তুলা চাষের জন্য নির্বাচিত করতে হবে। যে জমি স্যাঁতসেঁতে, ছায়া যুক্ত এবং যেখানে বৃষ্টির পানি ২-৬ ঘন্টার মধ্যে নেমে যায় না সেরূপ জমি তুলা চাষের জন্য নির্বাচন করা উচিত নয়। মাটির পিএইচ মান ৬.০ – ৭.৫ হওয়া উত্তম। মাটি বেশি অম্লীয় হলে জমিতে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
কিভাবে জমি তৈরি করবেন
আমাদের দেশে বর্তমানে উন্নত পদ্ধতিতে তুলা চাষ করা হচ্ছে। বর্ষার অবস্থা বুঝে মাটিতে জো থাকা অবস্থায় ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা ও সমতল করে তৈরি করতে হয়।
বীজ রোপণ করার জন্য উপযুক্ত সময়
আগাম শীত এলাকায় ( বিশেষ করে রংপুর দিনাজপুর এলাকা) শ্রাবণ মাস হতে ভাদ্রের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে অবশ্যই বীজ রোপণের কাজ শেষ করতে হবে। পাহাড়িয়া এলাকায় তীব্র বর্ষা শুরুর ১৫/২০ দিন পূর্বে (জমিতে ‘জো’ থাকা অবস্থায়) বীজ বপন করা উচিত। অর্থাৎ খরা মৌসুমে তুলা আবাদের জন্য জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে বীজ বপন করতে হবে। উত্তরবঙ্গ ও পাহাড়িয়া এলাকা ছাড়া অন্যান্য এলাকায় শ্রাবণের মাঝামাঝি হতে ভাদ্রের মাঝামাঝি পর্যন্ত বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। তবে মধ্য শ্রাবণের দিকে বীজ বপন উত্তম। যদি কোথাও বিশেষ কারণে বীজ বুনতে দেরি হয় তবে তা ভাদ্রের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
রোপণের জন্য বীজ তৈরি করবেন কিভাবে
রোপনের সুবিধার জন্য তুলাবীজ ৩-৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে তা ঝুরঝুরে মাটি বা শুকনো গোবর অথবা ছাই দিয়ে এমনভাবে ঘষে নিতে হবে যেন আঁশগুলো বীজের গায়ে লেগে যায় এবং বীজ একটা হতে অন্যটা আলাদা হয়ে যায়। এছাড়া লঘু সালফিউরিক এসিড দিয়ে বীজ আঁশ মুক্ত করেও রোপণ করা যায়। এতে বীজের গায়ে লেগে থাকা রোগ জীবাণু ও পোকার ডিম নষ্ট হয়ে যায়।
কতটুকু বীজ প্রয়োজন
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব ওপি জাতের ক্ষেত্রে প্রতি একরে প্রায় ৩ কেজি এবং হাইব্রিড বীজের ক্ষেত্রে প্রতি একরে ১.৫-১.৮ কেজি বীজ দরকার হয়।
যেভাবে তুলার বীজ রোপণ করবেন
উত্তর-দক্ষিণ লাইন করে সারিতে বীজ রোপণ করা ভালো। হাত লাঙল দিয়ে হালকা ভাবে সারি টেনে অনুমোদিত সার প্রতি সারিতে ভাল করে নিয়ে তা প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর নির্ধারিত দূরত্ব ১.২৫ সেঃ মিঃ থেকে ২.৫ সেঃ মিঃ গভীরে ৩/৪টি বীজ বুনে তা ঢেকে দিতে হবে।
সিবি -১ : সারির দূরত্ব ১০০ সেঃ মিঃ ও গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৫০-৬০ সেঃ মিঃ
অন্য সকল জাতের ক্ষেত্রেঃ সারির দূরত্ব ৯০-১০০ সেঃ মিঃ ও গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪৫-৫০ সেঃ মিঃ
অতিবৃষ্টি জনিত কারণ বা অন্য প্রতিকূল আবহাওয়ায় জমি চাষ করা সম্ভব না হলে এবং মাটি খুব ভিজে থাকলে ডিবলিং পদ্ধতিতে সারিতে বীজ পুঁতে দিতে হবে। এই পদ্ধতিতে অনুমোদিত সার গর্তে প্রয়োগ করে ৩/৪টি বীজ নির্ধারিত দূরত্বে বপন করতে হবে। অনেক সময় শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে জমিতে আউশ ধান বা পাট থাকে কিংবা প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে জমি পানিতে প্লাবিত থাকে, যে অবস্থায় বীজ বপন সম্ভব নয়। এরূপ অবস্থায় পলিব্যাগে চারা উৎপন্ন করে ২০-৩০ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে।
সার প্রয়োগ ও আগাছা দমন
তুলা চাষের জমি উর্বর হওয়া বাঞ্ছনীয়। উর্বরতা মান কম হলে জমিতে হেক্টর প্রতি ৫-৬ টন গোবর সার বা কম্পোস্ট সার দিতে হবে। এভাবে জৈব সার প্রয়োগ করা হলে জমিতে তুলনামূলক ভাবে কম রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হয়। এছাড়া জৈব সার প্রয়োগে জমিতে গৌণ পুষ্টি উপাদানের চাহিদাও পূরণ হয়। মাটির পিএইচ মান ৬.৫-এর কম হলে জমিতে হেক্টর প্রতি ২ টন চুন প্রয়োগ করতে হবে (বীজ বপনের ১ মাস পূর্বে বপন করতে হবে)। জৈব সার জমি তৈরির প্রথম দিকে প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
নিচে উল্লেখকৃত রাসায়নিক সার গুলো জমিতে দিতে হবে :
সারের নাম হেক্টর প্রতি একর প্রতি
১। ইউরিয়া ২০০-২৫০ কেজি ৮০-১০০ কেজি
২। টি.এস.পি ১৫০-১৭৫ কেজি ৬০-৭০ কেজি
৩। পটাশ সার ১০০-১৫০ কেজি ৪০-৬০ কেজি
৪। জিপসাম ২৫-৩০ কেজি ১০-১২ কেজি
সম্পূর্ণ টি.এস.পি, পটাশ সার ও জিপসাম জমি তৈরির শেষ দিকে দিতে হবে এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ ইউরিয়া-এর ১/৪ অংশ বীজ বপনের ঠিক পূর্বে সারিতে দিতে হবে। ইউরিয়া সার দেওয়ার পর তা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে যেন বীজের সাথে সরাসরি স্পর্শ না থাকে। বাকী ৩/৪ অংশ ইউরিয়া সমান তিন ভাগ করে তিন বারে প্রয়োগ করতে হবে।
চারার বয়স ইউরিয়া সার পার্শ্বে প্রয়োগ
২০-২৫ দিন ০.২৫ অংশ
৪০-৫০ দিন ০.২৫ অংশ
৬০-৭০ দিন ০.২৫ অংশ
ইউরিয়া জমিতে ছিটিয়ে দিতে হবে, তবে প্রতিবার ইউরিয়া প্রয়োগের আগে জমিতে নিড়ানি দিতে হবে।
আরও যে সব পরিচর্যা দরকার
১. চারা গজানোর ১০ দিন পর প্রথমবার প্রতিগর্তে ২টা ভাল চারা রেখে অবশিষ্ট চারাগুলো তুলে ফেলতে হবে। চারার বয়স ২০/২৫ দিন হলে দ্বিতীয়বার প্রতিগর্তে একটি সুস্থসবল মোটা চারা রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলতে হবে।
২. প্রতিবার চারা পাতলা করার সময় আগাছা তুলে ফেলতে হবে। গাছের গোড়ার মাটির উপরের স্তরে যদি শক্ত আস্তরন হয় তবে তা আগাছা নিড়ানোর সময় ভেঙ্গে দিতে হবে। আগাছা বেশি হলে সর্বাধিক ৩ বার আগাছা নিড়াতে হবে।
৩. সেচ-নিষ্কাশন রবি মৌসুমে মাটির আর্দ্রতা কম থাকতে পারে। মাটির রস আছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করে ২-৩ বার সেচ দিতে হবে। বর্ষা মৌসুমে তুলা চাষ করলে কখনো কখনো জলাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে। এরকম অবস্থা দেখা দিলে দ্রুত জলাবদ্ধতার অবসান ঘটাতে হবে।
তুলার বোল ওয়ার্ম পোকা দমনের উপায়
এ পোকার ক্ষতি কিভাবে সনাক্ত করবেন
পোকামাকড়ের মধ্যে বোল ওয়ার্ম তুলার প্রধান শত্রু। গাছের বয়স ৩/৪ সপ্তাহ হলে এই পোকা গাছর কান্ড (উপরের দিকের অংশ) ছিদ্র করে ঢুকে পড়ে ও কচি অংশ খেতে থাকে। সেজন্য ডগা নিস্তেজ হয়ে পড়ে ও পরে শুকিয়ে যায়। পোকার উপদ্রব বেশি হলে এরা ফুল ও ফল আক্রমণ করে। ফলত ফুল-ফল ঝরে পড়তে থাকে।
এই পোকা প্রতিকারের উপায়
পোকার আক্রমণের শুরুতে আক্রান্ত ডগা, কুঁড়ি বা ফল হাত দিয়ে পোকাসহ বেছে নিরাপদ দূরত্বে মাটির নিচে পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেলে এর উপদ্রব কিছুটা কমানো যায়। হাত বাছাইয়ের পর কীটনাশক ঔষধ ব্যবহার করা যেতে পারে। হেক্টর প্রতি ৩০০ মিঃ লিঃ রিপকর্ড/সুমিসাইডিন/সিমবুশ/ডেসিস২০-২৫ পানির সাথে মিশিয়ে (প্রতি স্প্রে মেশিনে ১২-১৫ মিঃলি ঔষধ) ভালভাবে পুরো গাছে ছিটিয়ে দিতে হবে। এই পোকা দমন করার জন্য আক্রমণের তীব্রতা অনুযায়ী ১৫-২০ দিন পর পর ৩-৪ বার ঔষধ ছিটানোর প্রয়োজন হতে পারে।
তুলা ফসলের অন্যান্য পোকামাকড়ের মধ্যে জ্যাসিড, জাব পোকা ও তুলার পাতা মোড়ানো পোকার উপদ্রব দেখা যেতে পারে। এসব পোকার আক্রমণ সহজভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অনুমোদিত ঔষধ মাত্রানুযায়ী প্রয়োগ করতে হবে।
তুলার রোগ হলে কি করবেন
তুলা গাছে বেশ কয়েকটি রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে; যথা- পাতা ঝলসানো, এনথ্রাকনোজ, নেতিয়ে পড়া, চারা ধসা ইত্যাদি। বীজ বাহিত রোগের জন্য বীজ শোধন করে বীজ বপন করতে হবে। রোগাক্রান্ত চারা তুলে পুড়িয়ে ফেলা উত্তম। জমিতে পানিবদ্ধতা থাকতে দেয়া যাবে না। রোগাক্রমণের সম্ভবনা আছে এমন ক্ষেতে ৫% কপার অক্সিক্লোরাইড বা ২.৫% ডাইথেন-গ-৪৫ প্রয়োগ করা যেতে পারে।
তুলা সংগ্রহ করার সময়
তুলা গাছের বোল ভালভাবে ফেটে বের হলে পরিষ্কার শুকনা দিনে বীজতুলা উঠাতে হয়।
তুলার ফলন :
স্বাভাবিক অবস্থায় কৃষক ঠিকমত কাজ করে থাকলে হেক্টর প্রতি ১২-১৫ কুইন্টাল বীজ তুলা উৎপন্ন হয়। তবে যথাযথ উন্নত প্রযুক্তি অবলম্বনে তুলা চাষ করলে ফলন এর দ্বিগুণ পাওয়া যায়।