আজ বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৪৫ পূর্বাহ্ন
থাই কৈ মাছের কৃত্রিম প্রজনন
থাই কৈ – প্রজনন ও চাষ
থাইল্যান্ড থেকে আমাদের দেশে আসে এই কৈ মাছ। যারা প্রথম এনেছিল দ্বিতীয় বার তারা পোনা আমদানি করার সাহস পায়নি। আমি সবকিছু শুনে বুঝতে পারলাম এই মাছ চাষে প্রতিবন্ধকতা কোথায়। থাই কৈ চাষে কিছু কারিগরী ত্রুটির কারণেই এমনটা হচ্ছে। থাইল্যান্ডের আবহাওয়া আর আমাদের দেশের আবহাওয়া শীতের ২ মাস বাদে প্রায় একই রকম। তার পরেও আমাদের দেশে এই মাছটি কেন বড় হচ্ছে না? থাইল্যান্ডে এই মাছ ১২০ দিনে বাজারজাত হলেও আমাদের দেশে হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে আমি যা জানাতে পারলাম তা হল
১. আমাদের দেশে কৈ মাছ আমদানি করা হত সেপ্টেম্বরের দিকে। এর এক মাস বা দেড় মাসের মধ্যেই শীত এসে যেত। শীতের পরে এই মাছটি আর তেমন না বাড়ার কারণে সবার মাঝে এই মাছ চাষে অনিহা দেখা দেয়।
২. পোনার উচ্চমূল্য এবং ব্যাপক মৃত্যুহার এর আরেকটি কারণ। যেমন প্রতিটি পোনার মূল্য ৩ টাকা করে আনার পর যদি ৫০% পোনা মারা যায় তাহলে প্রতিটি পোনার মূল্য দাঁড়ায় ৬ টাকা। মৃত্যহার যদি একটু বেশি হয় তাহলে পোনার মূল্য আরো অনেক বেড়ে যায়।
৩. মানসম্মত খাবার তৈরি করতে না পারা আরেকটি কারণ।। কৈ মাছের খাবারে কার্প বা পাঙ্গাস মাছের খাবারের চেয়ে আরো বেশি পরিমাণ প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। এ সময় এ ধরনের খাবার কোন মাছের কোম্পানি তৈরি করত না। এই সব মাথায় রেখেই আমি আমার থাই কৈ মাছের প্রজনন ও চাষের মিশন শুরু করলাম।
প্রথমে রেনু তারপর পোনা এবং সব শেষে চাষ। এক্ষেত্রে ২০০০ সালে উৎপাদন করা আমাদের দেশীয় কৈ মাছের প্রজননের অভিজ্ঞতা কাজে লাগালাম। আগের অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখেই থাই কৈ চাষে এগিয়ে যেতে লাগলাম। প্রথমে পোনার কীভাবে মৃত্যহার কম হয় সেটা বের করলাম। তারপর খাদ্যের প্রোটিনের হার ৩৫% রেখে খাবার বানানোর পরামর্শ দিয়ে খামারিদের কাছে পোনা বিক্রি শুরু করলাম। ফলাফল আসতে শুরু হল। খামারিরা ব্যাপক লাভের মুখ দেখলেন এবং আমাকে উৎসাহিত করলেন। আমিও অনুপ্রাণিত হয়ে এটাকে আরো কীভাবে সম্প্রসারণ করা যায় চিন্তা করতে লাগলাম। প্রথমে সৌদি বাংলা ফিড কোম্পানি আমার বানানো খাদ্যের ফলাফলের ভিত্তিতে খাদ্য বানানো শুরু করল। খামারিরা আরো অনুপ্রাণিত হল।
থাই কৈ এর ব্রুড ব্যবস্থাপনা: প্রথমে পুকুরের তলা ভাল করে শুকিয়ে নিতে হবে। পুকুরের তলা যদি শুকানো সম্ভব না হয় তাহলে জাল টেনে বা রটেনন প্রয়োগ করে সমস্ত অবাঞ্ছিত মাছ মেরে এক সপ্তাহ পর প্রতি শতাংশে ১ কেজিহারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। তারপর পুকুর পাড়ের চারপাশ দিয়ে মাটির ১ ফুট গভীর দিয়ে পলিথিন জাতীয় (যা মাটির নীচেও নষ্ট হয় না) জাল দিয়ে ভালভাবে বেড়া দিতে হবে। তারপর পুকুরে পানি দিতে হবে। পুকুরের পানির গভীরতা ৩ থেকে ৪ ফুট এবং অপেক্ষাকৃত কম কাঁদাযুক্ত পুকুর হলে ভাল হয়। পুকুরের দ্রুত বর্ধনশীল সুস্থ ও সবল মাছ প্রজননের জন্য মজুদ করতে হবে। যতদূর সম্ভব বেশি সংখ্যক মাছ থেকে কম সংখ্যক ব্রুড নির্বাচন করাই উত্তম এবং নির্বাচিত মাছকে অবশ্যই ভালভাবে যত্ন করতে হবে। ব্রুড প্রতিপালনের সাধারণত ১৫ থেকে ২০ শতাংশের পুকুর হলে ভাল। প্রতি শতাংশে ১০০ থেকে ১৫০ টি ব্রুড মাছ মজুত করা ভাল। খাবার হিসাবে বাজারের কৈ মাছের যে কোন ব্রান্ডের গ্রোয়ার খাবার খাওয়ালেই চলবে। দেহের ওজনের ৩% খাবারই যথেষ্ট। এর চেয়ে বেশি খাবার দিলে কৈ মাছের দেহে বেশি চর্বি হয়ে যেতে পারে। শীতকালে ব্রুড মাছের বিশেষ পরিচর্যা করতে হবে।
প্রজনন : চাষাবাদের জন্য ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত কৈ মাছের প্রজননের জন্য উপযুক্ত সময়। এ ছাড়াও কৈ মাছ যে কেউ ইচ্ছা করলে প্রায় সারা বছরই প্রজনন করাতে পারে। সঠিক পরিচর্যা করলে প্রায় সারা বছরই পেটভর্তি ডিম থাকে যা দেখে স্ত্রী কৈ মাছ সনাক্ত করা যায়। এ ছাড়াও স্ত্রী কৈ মাছ পুরুষ কৈ মাছের তুলনায় অনেক বেশি বড় হয়ে থাকে। পুরুষ কৈ মাছকে সনাক্তের জন্য প্রজনন মৌসুমে পেটে হালকা চাপ দিলেই সাদা রঙের শুক্রাণু বের হয়ে আসে।
প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে ১টি ইনঞ্জেকশন দিলেই চলে। ইনঞ্জেকশন দিতে হবে পি.জি. দিয়ে। স্ত্রী মাছের জন্য মাত্রা হবে ৬ থেকে ৮ মিঃ গ্রাঃ/কেজি, আর প্রতি কেজি পুরুষ মাছের জন্য পি.জি. দিতে হবে ২ থেকে ৩ মিঃ গ্রাঃ। ইনঞ্জেকশন দিতে হবে মুখের কাছে পাখনার নীচে ফুলার অংশে। পি. জি. দেয়ার পর স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে সমান অনুপাতে অর্থাৎ ১ : ১ অনুপাতে প্রজনন ট্যাংকে রেখে তারপর পানির স্রোতসহ ঝর্ণার ব্যবস্থা করতে হবে। ইনঞ্জেকশন দেয়ার ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা পর মাছ ডিম দিতে শুরু করবে। ডিম ছাড়ার পর ডিমগুলোকে হ্যাচিং ট্যাংকে নিয়ে যেতে হবে। কৈ মাছের ডিমগুলো ভেসে থাকে। সে জন্য ডিমগুলোকে বিশেষ কায়দায় হ্যাচিং ট্যাংকে নিয়ে যেতে হবে। কৈ মাছের ডিম ভাসমান বিধায় আমি এক বিশেষ পদ্ধতিতে ডিম সংগ্রহের কথা উল্লেখ করছি যা আমাদের দেশে প্রথম। ডিম সংগ্রহের সময় সর্তকতার অভাবে অনেক ডিম নষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে প্রজনন ট্যাংক থেকে হ্যাচিং ট্যাংক পর্যন্ত ৩ থেকে ৪টি সিরিজ ট্যাংক পাশাপাশি রাখতে হবে। প্রজনন ট্যাংক থেকে প্রতিটি ট্যাংকের বর্হিগমন নালা ২ ইঞ্চি নীচু হতে হবে। তাতে ডিমগুলো আপনা আপনি প্রজনন ট্যাংক থেকে হ্যাচিং ট্যাংকে এসে জমা হবে। নিষিক্ত ডিম এরেটরের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ ও পানি চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। তাপমাত্রা ভেদে ১৮/২০ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে। এরপর ২ থেকে ৩ দিন হ্যাচিং ট্যাংকে রাখার পর রেনু পোনাকে সিদ্ধ ডিমের কুসুম ভাল করে ব্লেন্ডার করে তারপর ছেঁকে খাবার হিসাবে দিতে হবে। এভাবে ক’দিন খাওয়ানোর পর নার্সারি পুকুরে স্থানান্তর করতে হবে
নার্সারি ব্যবস্থাপনা : নার্সারি পুকুরের ব্যবস্থাপনা ২টি ধাপে করা যায়। প্রথমটি হল ১টি পুকুর ব্যবহার করে আর দ্বিতীয়টি হল ২টি পুকুর ব্যবহার করে। ১টি পুকুর ব্যবহার করে পোনা উৎপাদন করলে পোনা ছোট বড় হয়ে যায় এবং চাষের ক্ষেত্রে নানাবিধ অসুবিধা হয়। ২টি পুকুর ব্যবহার করলে পোনা তেমন ছোট বড় হয় না। সে জন্য ২টি পুকুর ব্যবহার করাই ভাল। নার্সারি পুকুর আয়তাকার হলে ভাল হয়। এক্ষেত্রে ২য় পদ্ধতির কথা উল্লেখ থাকছে অর্থাৎ ২টি পুকুর ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। প্রথম পুকুরের আয়তন হবে ১০/১৫ শতাংশ এবং ২য় পুকুরের আয়তন হবে ৪০/৫০ শতাংশ। প্রথম পুকুরের পানি সেচ দিয়ে শুকিয়ে শতাংশ প্রতি ১ কেজি চুন পানির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিয়ে শুকাতে হবে। পুকুরের তলা শুকানোর পর পুকুরের পাড়ের চারপাশে জাল দিয়ে ঘিরে শ্যাল মেশিন বা গভীর নলকূপের সাহায্যে ৩ ফুট পরিষ্কার পানি দিতে হবে। পানি দেয়ার পর পরই শতাংশ প্রতি ১০০ গ্রাম আটা পানির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এর ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাণী প্ল্যাংটন জন্মাবে যা কৈ মাছে রেনুর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আটা দেয়ার ২ দিন পর পুকুরে সন্ধ্যায় ০.২ পি.পি.এম হারে সুমিথিয়ন পানির সাথে মিশিয়ে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এর ২দিন পর রেনু মজুত করতে হবে। ১৫/২০ শতাংশের নার্সারি পুকুরের জন্য ১০০/১৫০ জোড়া কৈ মাছের ব্রুড থেকে উৎপাদিত রেনু পুকুরে ছাড়া উচিৎ। এ পুকুরে ৭/৮ দিন খাওয়ানোর পর রেনুগুলো ধানীপোনাতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। তখন এই ধানীপোনাকে গ্লাস নাইলন কাপড়ের তৈরি হাপা দিয়ে কাটাই করে ২য় পুকুরে স্থানান্তরিত করতে হবে। এভাবে আরো ১০ দিন খাওয়ানোর পর ধানীপোনাগুলো চারা পোনাতে পরিণত হবে যা পরবর্তীতে চাষের পুকুরে ছাড়তে হবে।
খাবার প্রয়োগ : রেনু ছাড়ার পর থেকেই পুকুরে সম্পূরক খাবার প্রয়োগ করতে হবে। খাবার হিসেবে ২০ শতাংশের একটি পুকুরে প্রতিবারে ১০টি হাঁসের ডিম সিদ্ধ করে ডিমের সাদা অংশসহ ভালভাবে ব্লেন্ডারে মিহি করে গ্লাস নাইলনের কাপড় দিয়ে ছেঁকে পানির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
এভাবে দৈনিক ২/৩ বার খাবার প্রয়োগ করতে হবে। ২ দিন খাবার দেয়ার পর ৩য় দিন থেকে ওই পরিমাণ ডিমের সাথে আরো আধাকেজি আটা সিদ্ধ করে ওই ডিমের সাথে মিশিয়ে পুকুরে দিনে ২/৩ বার প্রয়োগ করতে হবে। আটা প্রয়োগে রেনুমাছ খাওয়ার পাশাপাশি অধিক পরিমাণে প্রাণী প্ল্যাংকটনের জন্ম হবে যা রেনুপোনার জন্য খুবই দরকারী। এভাবে ৫/৬ দিন খাওয়ানোর পর রেনুপোনাগুলো ধানীপোনাতে পরিণত হবে যা পরবর্তীতে কাটাই পুকুরে অর্থাৎ ২য় পুকুরে স্থানান্তরিত করতে হবে। এই পুকুরে ধানীপোনার খাবার হিসাবে বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি নার্সারি খাবার খাওয়াতে হবে। খাবারে প্রয়োগ পদ্ধতিতে নার্সারি খাবারকে ১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে তারপর পোনাকে খাওয়ানো উচিৎ। খাবারের পরিমাণ হবে প্রতি ৪ লক্ষ মাছের জন্য ১০ কেজি খাবার। এভাবে ৮/১০দিন খাওয়ানোর পর পোনাগুলো এক থেকে দেড় ইঞ্চি সাইজের হলে পরবর্তীতে চাষের পুকুরে ছাড়তে হবে।
ভাল ব্যবস্থাপনা নিলে ছোট বড় সব ধরনের পুকুরে কৈ মাছের চাষ করা যায়। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বর্গাকার পুকুরের চেয়ে আয়তাকার পুকুরে কৈ চাষের ফলন বেশি হয়। ২ ধাপে এই মাছের চাষ করা যায়।
একটি পুকুর ব্যবহার করে বা সরাসরি এবং দু’টি পুকুর ব্যবহার করে বা নার্সিং করে।
একটি পুকুর ব্যবহার পদ্ধতি : একটি পুকুর ব্যবহার করে বা সরাসরি প্রায় এক ইঞ্চি সাইজের কৈ মাছের পোনা ছাড়লে ওই পুকুরের ২য় পদ্ধতির চেয়ে কমপক্ষে ১০ দিন আগে বাজারজাত করা যায়। এ ক্ষেত্রে পোনার মজুদ থেকে ২০% পোনা বাদ দিয়ে পোনা মজুদ ধরতে হবে। যেমন সরাসরি একটি পুকুরে ৫০ হাজার পোনা ছাড়ার পর ওই পুকুরের মজুদ ধরতে হবে ৪০ হাজার।
২য় পুকুর ব্যবহার পদ্ধতি : ২য় পুকুর ব্যবহার করেও এই মাছের চাষ করা যায়। সে ক্ষেত্রে প্রথমে একটি ছোট পুকুরে প্রায় এক ইঞ্চি সাইজের কৈ মাছের পোনা ছেড়ে নার্সিং করতে হবে প্রায় ২০ দিন। এক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে প্রায় ২ হাজার পোনা মজুদ করা যাবে। প্রায় ২০ দিন নার্সিং করার পর ২য় পুকুরে স্থনান্তর করতে হবে। কৈ মাছের পোনা স্থানান্তর করার সময় কিছু বিশেষ দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেমন মেঘলা আকাশে কৈ মাছের পোনা স্থনান্তর করা উচিৎ হবে না। রৌদ্রজ্জ্বল আকাশে বেলা ১১ টার দিকে কৈ মাছের পোনা স্থানান্তর করতে হবে। আবার বেলা ১২ টার পর স্থনান্তর করা ঠিক হবে না। ১১টার আগে পোনা স্থানান্তর করলে কিছু বোঝার আগেই পোনা হঠাৎ করে মারা যেতে পারে। আবার বেলা ১২ টার পরে পোনা স্থানান্তর করলে অতিরিক্ত রোদের তাপে কৈ মাছের পোনা সহজেই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
পুকুর নির্বাচন : সাধারণত দো-আঁশ, এটেল দো-আঁশ এমনকি বেলে দো-আঁশ মাটির পুকুর এবং যে সমস্ত পুকুরে বন্যার পানি ওঠে না, পানির ধারণ ক্ষমতা বেশি সেই সমস্ত পুকুরে কৈ মাছ চাষের উপযোগী। আয়তাকার পুকুরের আয়তন ৬০ থেকে ৮০ শতাংশের হলে ভাল। পানি পরিবর্তনের সুবিধা থাকতে হবে। পুকুরের গভীরতা ৪ থেকে ৫ ফুট হলে ভাল। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে ৩ থেকে ৪ ফুট গভীরতার পুকুরেও এ মাছ চাষ করা যায়। সেক্ষেত্রে মাছের মজুদ ঘনত্ব একটু কম দিতে হবে।
পুকুর তৈরি : নতুন ও পুরাতন উভয় ধরনের পুকুরে কৈ মাছ চাষ করা যায়। নতুন পুকুরের তলায় শতাংশ প্রতি ১০ কেজি গোবর ছিটিয়ে তারপর হালকা চাষ দিতে হবে। তারপর অল্প একটু পানি দিয়ে ভাল করে মই দিতে হবে। পুরাতন পুকুর হলে প্রথমেই পুকুরের পানি সেচ দিয়ে শুকিয়ে ফেলতে হবে। তারপর স্যাঁতস্যাঁতে থাকা অবস্থায় শতাংশ প্রতি এক কেজি চুন পানির সাথে গুলে ছিটিয়ে দিয়ে ভাল করে মই দিতে হবে। এ সময় পুকুর শুকাতে দিতে হবে। পুকুরের তলার মাটি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেলে পুকুর চাষ করার উপযোগী হয়ে উঠবে। এ ছাড়া সারাবছর পানি থাকে এমন পুকুরেও কৈ মাছের চাষ করা যাবে। এক্ষেত্রে পুকুরে বিষটোপ বা রটেনন পাউডার দিয়ে অবাঞ্চিত বা রাক্ষুসে মাছ নিধন করতে হবে। তারপর শতাংশপ্রতি ১কেজি চুন পানির সাথে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। সারাবছর অতিরিক্ত কাদা-পানি থাকে এমন পুকুরে কৈ মাছের চাষ না করাই ভাল। উল্লেখিত পদ্ধতি অনুসরণ করে পুকুর তৈরির কাজ শেষ করতে হবে। এরপর পুকুরের পাড়ের উপর দিয়ে জাল দিয়ে ঘের দিতে হবে যাতে পুকুরের ভেতর সাপ, ব্যাঙ ঢুকতে পারে না। এ ছাড়াও মার্চ এপ্রিলে কৈ মাছ মজুদ করলে পুকুর থেকে মাছ উঠে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। মে মাস বা তারপরে কৈ মাছ মজুদ করলে পরবর্তী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুকুর থেকে উঠে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে না। উল্লেখিত পদ্ধতি অনুসরণের পর পুকুরে ২ ফুট পানি দিয়ে পোনা মজুদ করতে হবে।
মজুদ ঘনত্ব : একটি পুকুরে প্রতি শতাংশে ৫০০ থেকে ১০০০ টি কৈ মাছ মজুদ করা যায়। যদিও কয়েক বছর আগে মজুদ ঘনত্ব শতাংশে ৩০০ দিয়ে শুরু হয়েছিল। পানি পরিবর্তনের সুযোগের উপর মজুদ ঘনত্ব নির্ভরশীল। পানি পরিবর্তনের সুযোগ যত বেশি থাকবে কৈ মাছের মজুদ তত বেশি দেয়া যাবে। তবে মজুদ ঘনত্ব শতাংশে ১০০০টির বেশি দেয়া মোটেই ঠিক নয়।
পোনা মজুদ : পুকুর তৈরির ৪ থেকে ৫ দিন পর অর্থাৎ পানি দেয়ার ৪ থেকে ৫ দিন পর পোনা মজুদ করতে হবে। এর আগে পুকুরে পানি তোলার পরদিনই শতাংশ প্রতি ১০০ গ্রাম আটা ছিটিয়ে দিলে প্রচুর পরিমাণে প্রাণি প্ল্যাংকটনের জন্ম হবে যা কৈ মাছ চাষের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। মজুদকালীন সময়ে পোনার মৃত্যুহার কমানোর জন্য নিচের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করতে হবে-
১. পোনা ছাড়তে হবে পড়ন্ত বিকেল অথবা সন্ধ্যায়।
২. পুকুরের চারদিকে অপেক্ষাকৃত কম পানির মধ্যে মাছ ছাড়তে হবে।
৩. পোনা ছাড়ার আগে পোনাকে পুকুরের পানির সাথে ভালভাবে কন্ডিশন করতে হবে। অন্যথায় পুকুরের তলায় মাছ বসে গিয়ে উপরে না উঠার কারণে ব্যাপকহারে মারা যাবার সম্ভাবনা থাকে। পোনার যাতে কোনো ক্ষতি না হয় তার জন্য অক্সিজেন ভর্তি পোনার ব্যাগগুলোকে প্রথমে পুকুরের পানিতে ঘণ্টাখানেক ভাসিয়ে রাখার পর ধীরে ধীরে ব্যাগের মুখ খুলতে হবে। তারপর ব্যাগের কিছু পানি পুকুরে ফেলে দিয়ে পুকুর থেকে কিছু পানি ব্যাগে ভরতে হবে। এভাবে কয়েকবার পানি বদল করার পর পুকুরের পানিতে হাত দিয়ে তাপমাত্রা এবং ব্যাগের ভেতর হাত দিয়ে ব্যাগের পানির তাপমাত্রা দেখতে হবে। যখন পুকুর ও ব্যাগের পানির তাপমাত্রা একই মনে হবে তখন হালকা স্রোতে কৈ মাছের পোনাগুলোকে ছাড়তে হবে।
৪. পোনা ছাড়ার পরের দিন সমস্ত পুকুরে ২ ফুট পানির জন্য আধা কেজি আর ৩ ফুট পানির জন্য ৭৫০ গ্রাম লবণ পানির সাথে গুলে নিয়ে দিনের আলোতে ছিটিয়ে দিতে হবে। এভাবে এক সপ্তাহ পর একইহারে আরেকটি লবণের ডোজ পুকুরে দিতে হবে।
খাদ্য প্রয়োগ : থাই কৈ মাছের দৈহিক বৃদ্ধি অব্যাহত রাখার জন্য নিয়মিত খাবার প্রয়োগ অপরিহার্য। পুকুরের পানিতে না নেমে খাবার প্রয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে চারদিকে খাবার প্রয়োগ করতে হবে। বাজারে এখন প্রায় সব ফিড কোম্পানিই কৈ মাছের খাবার তৈরি করে থাকে। ডুবন্ত এবং ভাসমান এই দু’ধরনের খাবার পাওয়া যায়। কৈ মাছের খাবার হিসাবে ভাসমান খাবারে ভাল ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। কোনো কোনো কোম্পানি কৈ মাছের গ্রোয়ার খাবারে ২৫% প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার হিসাবে পাওয়া যায়। কিন্তু অভিজ্ঞতার আলোতে দেখা গেছে, এ প্রোটিনে কৈ মাছের বৃদ্ধি ভাল হয় না। এ জন্য কৈ মাছের গ্রোয়ার খাবারে কমপক্ষে ৩০% প্রোটিন থাকা আবশ্যক। এ ছাড়া র্স্টাটার ও নার্সারিতে ৩৫% প্রোটিন থাকা আবশ্যক। কৈ মাছের বৃদ্ধির হার নিয়মিত রাখার জন্য নিচের তালিকা অনুসারে খাবার প্রয়োগ করতে হবেÑ ১ম ১০ দিন, দৈহিক ওজনের ৫০% (ক্রাম্বল), ২য় ১০ দিন দৈহিক ওজনের ৩০% (ক্রাম্বল), ৩য় ১০ দিন দৈহিক ওজনের ২০% (র্স্টাটার), ৪র্থ ১০ দিন দৈহিক ওজনের ১৫% (র্স্টাটার), ৫ম ১০ দিন দৈহিক ওজনের ১০% (র্স্টাটার), ৬ষ্ঠ ১০ দিন দৈহিক ওজনের ৫% (গ্রোয়ার), ৭ম ১০ দিন দৈহিক ওজনের ৩% (গ্রোয়ার), ৮ম ১০ দিন দৈহিক ওজনের ৩% (গ্রোয়ার)। এ হারে বাজারজাত করার আগ পর্যন্ত খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। দিনে ৩ বার খাবার প্রয়োগ করলেই যথেষ্ট। সঠিক উপায়ে পরিচর্যা করলে সাধারণ থাই কৈ ১২০ দিনেই বাজারজাত করা যায়। এ সময়ে থাই কৈ ৯০ থেকে ১০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন হয়ে থাকে। এক হিসাবে দেখা গেছে এক মৌসুমে এক শতাংশ জলাশয় থেকে দু’বার চাষ করলে প্রায় ১০০ কেজি কৈ মাছ উৎপাদন করা যায় আর এক একরে প্রায় ১০ টন।
থাই কৈ চাষের সময় যে সব বিষয়ে খেয়াল রাখা প্রয়োজন :
১. পোনা মজুদের পর পুকুরকে মাছরাঙা পাখি থেকে সাবধানে রাখতে হবে। এ পাখি ছোট পোনাকে খুব সহজেই খেয়ে ফেলতে পারে। তাই কমপক্ষে ১৫ দিনের ভেতরে মাছরাঙা যাতে পুকুরের আশপাশে না আসতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
২. স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য প্রতি ১০ দিন পর পর মাছের নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুকুরের এককোণা থেকে ঠেলাজাল অথবা ঝাঁকিজাল দিয়ে প্রায় কেজি দুয়েক মাছ নিয়ে ওজন করতে হবে। সেক্ষেত্রে ২% বড় মাছ উঠবে যা কখনো নমুনায়নে হিসাব ধরা যাবে না।
৩. অনেক ক্ষেত্রে নমুনায়নকৃত মাছগুলোতে ক্ষতরোগ দেখা দিতে পারে; সেজন্য এ মাছগুলোকে পুকুরে ছাড়ার আগে পটাসিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট দিয়ে হালকাভাবে ধুয়ে দিতে হবে। অবশ্য হালকা লবণ পানিতে গোসল দিলেও চলে।
৪. নমুনায়ন করতে হয় সকালবেলা। যেদিন নমুনায়ন করা হবে সেদিন সকালে পুকুরে খাবার দেওয়া যাবে না। বিকালবেলার দিকে খাবার প্রয়োগ করতে হবে এবং প্রতি ১৫ দিন পর পর একদিন খাবার বন্ধ রাখতে হবে। আবার খুব বৃষ্টির দিনে খাবার দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে। অন্যদিকে অধিক রোদেও দুপুরের খাবার বন্ধ রাখতে হবে।
৫. কৈ মাছের খাবারে অন্যান্য মাছের খাবারের তুলনায় বেশি পরিমাণ প্রোটিন থাকায় পুকুরে ফাইটোপ্যাংটনের বুম দেখা দেয়। এ জন্য চাষের ৬০ দিন পর থেকে ১০ দিন অন্তর অন্তর পানি বদলানো প্রয়োজন।
৬. যে পুকুরে পানি বদলানোর সুবিধা থাকে না সে পুকুরে আংশিক সেচের মাধ্যমে বুম দমন করা যায়। এক্ষেত্রে বুমের আবরন যে পাশে জমা হয় সে পাশে পানি থেকে এক ফুট দূরে একটা গর্ত করতে হবে। পানি থেকে ২.৫-৪ সে.মি. গভীর নালা ওই গর্তের সঙ্গে যুক্ত করে পানি সেচ দিলে বুমের আবরন আপনা আপনি গর্তে জমা হবে। এভাবে যখনই বুমের আধিক্য দেখা দেবে তখনই এ পদ্ধতিতে পানি সেচে বুমের আবরন সরিয়ে ফেলতে হবে।
৭. মাছ যদি হঠাৎ কম খায় বা খাওয়া ছেড়ে দেয় তাহলে পানির পি.এইচ এবং পুকুরের তলায় আ্যমোনিয়া গ্যাসের মাত্রা পরীক্ষা করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া মাছের রোগ-বালাই হলো কিনা তাও পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
কৈ মাছের রোগ-বালাই : চাষের সময়ে কৈ মাছের ক্ষতরোগ ছাড়া আর কোনো রোগ দেখা যায় না। সাধারণত নমুনায়ন পরীক্ষার সময় পুকুরে ছাড়া মাছগুলোই পরবর্তীতে ক্ষতরোগে আক্রান্ত হয় যা পরবর্তীতে ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে। এ ছাড়া ঘন ঘন জাল টানলেও ক্ষতরোগ দেখা দিতে পারে।
প্রতিকার : কৈ মাছের ক্ষতরোগ খুব দ্রুত ছড়ায়। সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিলে তাড়াতাড়ি ভালও হয়ে যায়। ক্ষতরোগের জন্য শতাংশপ্রতি এক কেজি লবণ পানির সাথে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এভাবে এক সপ্তাহ পর আরেকবার একই হারে প্রয়োগ করতে হবে।
শীতকালীন পরিচর্যা : থাই কৈর সাধারণত শীতকালে ক্ষতরোগ দেখা দেয়। তাই শীতকাল আসার আগেই মাছ বাজারজাত করতে হবে। তবে সর্তকতার সাথে ভাল ব্যবস্থাপনা নিলে শীতকালেও মাছ মজুদ রাখা যায়। শীতকালে মাছ মজুদ রাখার জন্য নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে-
১. সপ্তাহে অন্তত একদিন পুকুরের পানি পরিবর্তন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ২ ফুট পানি কমিয়ে শ্যালো দিয়ে নতুন পানি ভরে দিতে হবে।
২. প্রতি ১৫ দিন পর পর শতাংশপ্রতি এক কেজি লবণ সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
৩. মাছের ঘনত্ব প্রতি শতাংশে ১৫০ থেকে ২০০ এর মধ্যে আনতে হবে।
৪. শীতকালে অবশ্যই ভাসমান খাবার প্রয়োগ করতে হবে। খাবারের অপচয় থেকেও মাছের রোগ-বালাই হতে পারে। ১৫ দিন পর পর মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। যদি মাছের গায়ে কোনো রোগের লক্ষণ দেখা যায় তাহলে সাথে সাথে বাজারজাত করতে হবে। কেননা কৈ মাছে কোনো রোগ থাকলে বাজারে এর মূল্য পাওয়া যায় না।
৫. মাছের বাজারজাত ছাড়া কোনো অবস্থাতেই ব্যাপকহারে জাল টানা যাবে না।
থাই কৈ -এর বাজারজাতকরণ : থাই কৈ খেতে সুস্বাদু ও পুষ্টিসমৃদ্ধ। আমাদের দেশের অন্যান্য মাছের তুলনায় সবচেয়ে কম সময়ে এ মাছ বাজারজাত করা যায়। ১০০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যেই মাছ বাজারে বিক্রি করতে পারে খামারিরা। এর চেয়ে কম সময়ে আর কোনো মাছ বাজারজাত করা যায় না। কৈ মাছ বাজারজাত করার আগে কয়েকটা বিষয় দৃষ্টি রাখলে এই মাছের বাজার মূল্য ভাল পাওয়া যায়; অন্যদিকে নানা রকমের ঝুঁকি থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। নিম্ন লিখিত বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখলে খামারিরা লাভবান হতে পারবেন।
কৈ মাছের বাজারজাত করার কমপক্ষে একদিন আগে থেকে খাবার দেয়া বন্ধ করতে হবে। অনেক খামারিরা বেশি লাভের আশায় সকালের খাবার প্রয়োগের পর বিকেল বেলায় মাছ বিক্রি করে দেন যা কোনো অবস্থাতেই উচিৎ না। এতে মাছ খুব দুর্বল হয়ে যায় বিধায় বাজারে উঠানোর আগেই অনেক মাছ মারা যায়। এটা খামারি ও বিক্রেতাদের জন্য একটা ক্ষতিকর দিক।
কৈ মাছের বাজারজাত করতে গিয়ে দেখা যায় যে, ৮৫ গ্রামের বেশি ওজোন হলে মাছের ভাল দাম পাওয়া যায়। এ কারণে এই সাইজের মাছ বাজারজাত না করাই ভাল। অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা গেছে, ৬০ গ্রাম ওজোন পর্যন্ত যে হারে কৈ মাছের খাবার প্রয়োজন এর চেয়ে বেশি ওজোনসমৃদ্ধ করতে গেলে খাবারের হারও অর্ধেকে নেমে আসে। অর্থাৎ ৬০ গ্রাম ওজোনে আনতে যদি মাছকে গড়ে ৬ থেকে ৭% হারে খাবারের প্রয়োজন হয় সেখানে ৬০ থেকে ১০০ গ্রাম ওজোনে আনতে মাত্র ৩% হারে খাবার দিলেই চলে। কাজেই এত পরিশ্রম ও বিনিয়োগ করে ৬০ বা ৭০ গ্রাম পর্যন্ত যেতে পারলে আর একটু কষ্ট করে ১০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজোন বাড়ানোই ভাল। এই সাইজের মাছের আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদাও ভাল।
অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, একটি পুকুর থেকে কয়েক দিন মাছ ধরলে প্রথম দিনের চেয়ে পরের দিনগুলোতে কৈ মাছের ওজোন অনেক কমে যায়। অর্থাৎ শুরুতে কোনো মাছের গড় ওজোন যদি ৮০ গ্রাম দিয়ে শুরু হয় তাহলে শেষের মাছগুলোতে ওজোন দাঁড়ায় ৫০ গ্রামের মত। এখানে প্রথম দিন জাল টানার পর ভয় ও পীড়নে মাছগুলোর শরীরের জলীয় অংশ বের হয়ে গিয়ে দ্রুত ওজোন কমে যায়। কিছু ব্যবস্থা নিলে এই অবস্থা থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যায়। যেমন : কৈ মাছ যেদিন থেকে বাজারজাত শুরু করতে হবে সেদিন থেকে ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে বাজারজাত করা শেষ করতে হবে। সবচেয়ে ভাল হয় পুকুর সেচ দিয়ে ২ দিনের মধ্যে মাছ বিক্রি করে ফেলা। এ প্রক্রিয়ায় প্রথম দিন পুকুর সেচ দিয়ে শুকিয়ে সকাল বেলায় মাছ ধরার কাজ শেষ করতে হবে। মাছ ধরার পর পরই বাকি মাছগুলোতে পানি দিতে হবে। একই প্রক্রিয়ায় ২য় দিন পুকুর শুকিয়ে আবার মাছগুলো ধরে বাজারজাতের ব্যবস্থা করতে হবে। জাল টেনে মাছ ধরার চেয়ে এ প্রক্রিয়ায় মাছ বাজারজাত করলে ওজোনে বেশ লাভবান হওয়া যায়।
কৈ মাছ বাজারজাতের জন্য প্রথমে মাছগুলোকে ধরে পলিথিন জাতীয় একটি হাপায় রাখতে হবে। দৈর্ঘ্যে ১৫ ফুট এবং প্রস্থে ১০ ফুট একটি হাপায় ৭০০ থেকে ৮০০ কেজি মাছ ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা সহজেই রাখা যায়। তারপর আধা কেজি লবণ পানির সাথে মিশিয়ে এই হাপায় ছিটিয়ে দিতে হবে। এতে মাছগুলোতে ফাঙ্গাস পড়ার ভয় থাকে না। তারপর গাড়িতে ড্রাম ভর্তি পানিতে প্রতি ড্রামে ৩০ কেজি মাছ অনায়াসে পরিবহন করা সম্ভব। ৬ থেকে ৭ ঘণ্টার পরিবহনে প্রতি ড্রামে ৩৫ কেজি মাছ পরিবহন করা সম্ভব। ড্রামে মাছ ভরার পর প্রতি ড্রামে একটি করে খাবার স্যালাইন দিলে ড্রামে ফাঙ্গাসজনিত কোনো রোগে মাছ আক্রান্ত হয় না।
আমাদের দেশে থাই কৈ চাষের শুরুতে এর বাজার মূল্য ছিল অনেক বেশি। বর্তমানে বেশি চাষ হওয়ায় উৎপাদন যেমন বেড়ে গেছে তেমন বাজার মূল্যও কমে গেছে। বর্তমান বাজার মূল্যের বাস্তবতাকে সামনে রেখে ১ একর পুকুরের থাই কৈ মাছ চাষের আয় ব্যয়ের হিসেব দেয়া হল :
১ একর বা ১০০ শতাংশ পুকুরে মাছ মজুদ করা যায় কমপক্ষে ৬০,০০০টি। প্রতিটি পোনার মূল্য ৪০ পয়সা করে ধরা হলে পোনার মোট মূল্য দাঁড়ায় ২৪,০০০ টাকা। ১৩০ দিন পুকুরে মাছ রাখতে হয়। তাতে মাছের জন্য খাদ্যের প্রয়োজন হয় ১৩ টন, যার আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় ৪,৫৫,০০০ টাকা। পানি, বিদ্যুত, শ্রমিক ও আনুসাঙ্গিক আরো খরচ হয় ৩০,০০০ টাকা। সর্বমোট খরচ ধরা যায় ৫,০৯,০০০ টাকা।
মোট আয় : মজুদকৃত মাছের বেঁচে থাকার হার সাধারণত ৮০% ধরা হয়ে থাকে। আর এ হিসেবে মোট মাছের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৮,০০০টি, যার আনুমানিক গড় ওজোন ১০০ গ্রাম করে হলে মোট উৎপাদন হয় ৪,৮০০ কেজি। প্রতি কেজি মাছের মূল্য কমপক্ষে ১৫০ টাকা করে হলে মোট মূল্য হয় ৭,২০,০০০ টাকা।
প্রকৃত আয় :সবকিছু মিলিয়ে মোট ব্যয় ৫,০৯,০০০ টাকা এবং মোট বিক্রয় মূল্য ৭,২০,০০০ টাকা। তাহলে প্রকৃত আয় দাঁড়ায় ২,১১,০০০ টাকা।
আলোচিত পদ্ধতিতে যে কেউ প্রজনন মৌসুমে দু’বার খুব সহজেই থাই কৈ চাষ করতে পারেন। দু’বার চাষে এই মাছ প্রতি মৌসুমে প্রতি একরে ৮/১০ টন মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। এত স্বল্পকালীন সময়ে আমাদের দেশে আর কোনো মাছ বাজারজাত করা যায় না।
উপসংহারে আমাদের দেশি কৈ মাছ সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। দেশি কৈ মাছ অত্যন্ত সুস্বাদু একটি মাছ। থাই কৈ -এর চেয়ে এই মাছটি দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি খেতেও ভাল। যদি আমাদের দেশি কৈ মাছকে জন্মগতভাবে উন্নত বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ করে দ্রুত বৃদ্ধি ঘটিয়ে চাষের আওতায় আনা যায় তাহলে একদিকে যেমন এই মাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে, অন্যদিকে দেশবাসী এর স্বাদও গ্রহণ করতে পারবে সারাজীবন। আশা করি আমাদের দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো, মৎস্য বিজ্ঞানী এবং গবেষকগণ এ ব্যাপারে এগিয়ে আসবেন।
লেখক: এ. কে এম. নূরুল হক
স্বত্বাধীকারী : ব্রহ্মপুত্র ফিস সীড কমপ্লেক্স (হ্যাচারি) গ্রাম : চর পুলিয়ামারী,শম্ভূগঞ্জ, সদর, ময়মনসিংহ