আজ বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:১২ পূর্বাহ্ন

পারিবারিক পর্যায়ে খরগোশ পালন

পারিবারিক পর্যায়ে খরগোশ পালন

ভূমিকা

জনবহুল বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি একটি প্রধান সমস্যা। বিগত বছরগুলোতে দেখা যায় উৎপাদিত প্রাণিজ আমিষ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মিটাতে সক্ষম হচ্ছে না। কিন্তু মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে প্রাণিজ আমিষ যথাঃ দুধডিমমাংস ইত্যাদির গুরুত্ব ব্যাপক বা অপরিসীম। প্রতিদিন মাথাপিছু প্রাণিজ আমিষের প্রয়োজন ২৫ গ্রাম এবং প্রাপ্যতা ৫.৭ গ্রাম/জন। ফলে মানুষের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও মানসিক পরিপূর্ণতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশে শতকরা ৬৫ ভাগ লোক অতি দরিদ্র এবং অধিকাংশ লোক পুষ্টিহীনতায় ভূগছে। পারিবারিক পর্যায়ে খরগোশ পালন করে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণআয় বৃদ্ধি এবং আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। অন্য প্রাণির তুলনায় খরগোশ সহজেই পালন করা যায়। ইহার খাদ্য এবং ব্যবস্থাপনা সহজ বিধায় বাড়ীর মহিলা ও ছেলে মেয়েরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে সহজেই খরগোশ পালন করতে পারেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যথাঃ আমেরিকানিউজিল্যান্ডবৃটেননেদারল্যান্ডচীন জাপানসহ অনেক দেশে বাণিজ্যিকভাবে খরগোশ প্রতিপালন হয়। বাংলাদেশে ইহার পালন এবং মাংস এখনও জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। তবেবি,আর,ডি,বি এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য কিছু বেসরকারি সংস্থা খরগোশ পালনে খামারিদের উৎসাহিত করতে সক্ষম হয়েছে। বাণিজ্যিকভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খরগোশ পালন অত্যন্ত লাভজনক। বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির যে খরগোশ দেখা যায়তন্মধ্যে সাদাকালোডোরা এবং খয়েরী রংয়ের খরগোশ বেশী। বাংলাদেশে প্রাপ্ত জাতসমূহের মধ্যে ডার্ক গ্রে (নেটিভ),ফক্সডাচনিউজিল্যান্ড লালনিউজিল্যান্ড সাদানিউজিল্যান্ড কালোবিলজিয়াম সাদা এবং ছিনছিলা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

খরগোশ পালনের সুবিধাসমূহঃ

ইহা দ্রুত বর্ধনশীল প্রাণি।

বাচ্চা দেয়ার হার অত্যধিকএকসাথে ২৮ টি বাচ্চা প্রসব করে।

প্রজনন ক্ষমতা অধিক এবং একমাস পর পর বাচ্চা প্রদান করে।

খাদ্য দক্ষতা অপেক্ষাকৃত ভাল।

মাংস উৎপাদনে পোল্ট্রির পরেই খরগোশের অবস্থান।

অল্প জায়গায় স্বল্প খাদ্যে পারিবারিক পর্যায়ে পালন করা যায়।

অল্প খরছে অধিক উৎপাদন সম্ভব।

খরগোশের মাংস অধিক পুষ্টিমান সম্পন্ন ও উন্নতমানের।

সব ধর্মের লোকই ইহার মাংস খেতে পারে তাতে কোন সামাজিক বাধা নেই।

১০রান্না ঘরের উচ্ছিষ্টাংশবাড়ীর পাশের ঘাস এবং লতা পাতা খেয়ে ইহার উৎপাদন সম্ভব।

আরও পড়ুন   পুকুর খননে মাটির হিসাব

১১পারিবারিক শ্রমের সফল ব্যবহার করা সম্ভব।

১২বিলাসবহুল হোটেলরেস্তোরা এবং বড় বড় ভোজসভায় এদের মাংসের যথেষ্ট সমাদর আছে।

টেবিলঃ ২খরগোশের শারিরীক ও বায়োলজিক্যাল বৈশিষ্ট্যাবলী।

গুণাবলী

পর্যবেক্ষণ

মন্তব্য

পায়ুর তাপমাত্রা গড়ে ৩৯.º সেঃরেঞ্জ ৩৮º –৪০ºসেঃ জাতের পার্থক্য বিদ্যমান এবং ছোট প্রাণীতে বেশী তাপমাত্রা থাকে।
নাড়ী স্পন্দন (১৫০৩০০বিট/মিনিট খুব ছোট খরগোশের হৃদ স্পন্দন বেশী হয়।
শ্বাসপ্রশ্বাসের হার ৩০১০০/মিঃ প্রাপ্ত বয়সে গড়ে ৫৫০
দুগ্ধ দান কাল গড়ে ৪২ দিন
বাচ্চা প্রদানের হার/মাদী খরগোশ/বৎসর ১০ সাধারণতপ্রদর্শনী জাত গুলিতে কম হয় তবে অভ্যন্তরীণ ফার্মে ব্যবহৃত জাত গুলিতে ইহার সংখ্যা বেশী হয়।
বাচ্চার সংখ্যা ১৪টি ইহা নির্ভর করে জাতস্ট্রেইন পার্থক্যের উপর। মাঝারি আকারের প্রদর্শনী স্টকে কম গড়ে ৫৬টি কিন্তু বাণিজ্যিক জাতে ৮৯টি।
জীবনকাল ১১ বৎসর
পূর্ণতা প্রাপ্তির বয়স ১৬২৬ সপ্তাহ ছোট জাতের পূর্ণতা প্রাপ্তি আগে হয়।
গর্ভধারণ কাল ৩১৩২ দিন তবে ইহা ২৯৩৪ দিন হতে পারে
প্রাপ্ত বয়স্ক ওজন .৫ কেজি তবে খুব কম ক্ষেত্রে ১২ কেজি পর্যন্ত ওজন হয়।
সেক্স রেশিও ১০০ পুরুষ ঃ ১০২ স্ত্রী খরগোশ

খরগোশ প্রতিপালনের প্রয়োজনীয় তথ্যাবলীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ

বাসস্থানঃ

বাণিজ্যিকভাবে খরগোশ প্রতিপালনের জন্য বহুতল বিশিষ্ট খাঁচা এবং মেঝেতে খরগোশ পালন করা যায়। স্বাভাবিকভাবে জাত অনুযায়ী মেঝের আকার বিভিন্ন ধরণের হয়। সাধারণতঃ প্রতি ৮টি বয়স্ক খরগোশের জন্য ৫৴*২৴ বর্গফুট একটি খাঁচার প্রয়োজন হয় এবং প্রজননের সময় আলাদা প্রজনন ঘর ব্যবহার করা (১ বর্গফুট//২ কেজি দৈহিক ওজনের জন্যহয়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের খরগোশ ছেড়ে পালন করা যায়তবে বাচ্চা দেয়ার সময় এরা নিজেরাই গর্ত খুড়ে নিজের গায়ের লোম ছিড়ে বাসা তৈরী করে। যদি খাঁচায় পালন করা হয়তবে বাচ্চা দেয়ার সময় মেটার্নিটি বক্স বা নেট ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক খরগোশের খাঁচার পরিমাপ ও মেটার্নিটি বক্সের পরিমাপ দেয়া হলোঃ

আরও পড়ুন   কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ৯ শতাধিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে
খরগোশের ঘরের/খাঁচার পরিমাপ মেটার্নিটি বক্সের পরিমাপ
প্রতিটি খরগোশের জন্য খাঁচার পরিমাপ

দৈর্ঘ্য– ৭৫ সেঃ মিঃ

প্রস্থ– ৪৫ সেঃ মিঃ এবং

উচ্চতা– ৩৫ সেঃ মিঃ

দৈর্ঘ্য– ৪০ সেঃ মিঃ

প্রস্থ– ৩০ সেঃ মিঃ

উচ্চতা– ২৫ সেঃ মিঃ

দরজা১৫ সেঃ মিঃ

খাদ্যঃ বয়স ও জাত ভেদে খরগোশের খাদ্য গ্রহণ ও পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা ভিন্ন হয়। খরগোশের খাদ্যের বিভিন্ন তথ্য নিচে দেয়া হলোঃ

একটি বয়স্ক খরগোশের খাদ্য রসদে পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা খাদ্য গ্রহণ খাদ্য উপাদানসমূহ
ক্রুড প্রোটিন (সিপি) = ১৭% (ভাগ)

আঁশ (ফাইভার)= ১৪% (ভাগ)

মিনারেল বিপাকীয় শক্তি

(এমই)=১১ মেগাজুল/কেজি

বয়স্ক খরগোশ=১৩০১৪৫ গ্রাম/দিন

দুধালা খরখোশ২৫০৩০০

গ্রাম/দিন বাড়ন্ত খরগোশ=৯০ গ্রাম/দিন

সবুজ শাকসবজি,ঋতু ভিত্তিক সবজিপালং শাকগাজরমুলাশশাশাকের উচ্ছিষ্টাংশসবুজ ঘাস ইত্যাদি।

দানাদার খাদ্যঃ

চালগমভুট্টাতৈলবীজ ইত্যাদি। তবে বাণিজ্যিকভাবে খরগোশ পালনের জন্য মুরগির মত তৈরীকৃত মিশ্রিত খাদ্য খরগোশের রেশন হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

প্রজননঃ খরগোশ সাধারণত৬ মাস বয়সে প্রথম প্রজননক্ষম হয়তবে ঋতু এবং পর্যাপ্ত ওজন প্রাপ্তির উপর ইহা অনেকাংশে নির্ভরশীল। গর্ভবতী খরগোশ ২৮৩৪ দিনের মধ্যে বাচ্চা দেয় এবং বাচ্চার ওজন খরগোশের শারিরীক ওজনের উপর নির্ভরশীল এবং ইহা সাধারণতদৈহিক ওজনের ২হয় অর্থাৎ ১.২৫ কেজি (সোয়া কেজিওজনের একটি খরগোশের বাচ্চার ওজন হয় ৩০ গ্রাম। খরগোশের দুগ্ধদান কাল সময় ৬৮ সপ্তাহ এবং উইনিং ওজন হলো ৮০০১২০০ গ্রাম। খরগোশ প্রতিবার ২৮টি বাচ্চা প্রদান করে এবং একবার বাচ্চা দেয়ার ৩ মাস পরেই আবার বাচ্চা দিতে পারেতবে গর্ভবতী খরগোশকে পৃথক করে রাখা প্রয়োজন।

খরগোশের বাচ্চার যত্নঃ খরগোশ ছোট প্রাণি যদিও ইহা একসঙ্গে ৬৮টি বাচ্চা দেয়। তাই অনেক সময় প্রথম দশ দিনে এই বাচ্চাগুলোর বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়যেমনঃ মা খরগোশ হতে দুধ খেতে সাহায্য করাপ্রয়োজনে ফিডারে করে দুধ খাওয়ানোভাতের মাড় বা দুধে বিস্কুট ভিজিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। তাছাড়া বাচ্চার ঘরের প্রয়োজনীয় তাপের ব্যবস্থা করাপ্রিডেটরলাল পিঁপড়া ইত্যাদির হাত থেকে বাচ্চা রক্ষা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক।

খরগোশের রোগবালাইঃ খরগোশ অতিশয় সুন্দর এবং নরম প্রকৃতির প্রাণী। ইহা অত্যধিক পোষ মানে। খরগোশের রোগ তুলনামূলক ভাবে কম। খরগোশ পরিচ্ছন্ন জায়গায় থাকতে বেশী পছন্দ করে। ইহার ঘর সর্বদাই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা প্রয়োজন। ঘরে প্রয়োজনীয় আলো বাতাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ঘরে অতিরিক্ত তাপমাত্রাধুলাবালি,পোকামাকড়ইঁদুরপিঁপড়া ইত্যাদি রোধ করতে হবে। ঘরে ২৯ºসেঃ এর বেশী তাপমাত্রা থাকলে পুরুষ খরগোশের সাধারণতঅনুর্বরতা দেখা যায়। তাছাড়া কক্সিডিওসিস,গলাফুলাপাস্তুরেলোসিস প্রভৃতি কয়েকটি রোগ খরগোশের সাধারণতদেখা দেয়। নিম্নে অসুস্থ খরগোশের কয়েকটি লক্ষণ দেয়া হলোঃ

চোখকান খাড়া থাকে না।

লোম শুস্ক ও রুক্ষ দেখায়।

খাদ্যপানি খেতে অনীহা প্রকাশ করে।

দৌড়াদৌড়ি কম করে।

শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।

খরগোশ পালনে ঝুঁকিপূর্ণ দিকসমূহঃ

উৎপাদিত দ্রব্যের বাজারজাতকরণে সমস্যা।

খরগোশের মাংস সবাই খেতে চায় না।

খরগোশ অসুস্থ হলে বাঁচানো সম্ভব হয় না।

খরগোশের ইউরিনে ভীষণ গন্ধ থাকে।

বাচ্চার যত্ন বিশেষ করে প্রথম ১০ দিন সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

উপসংহারঃ বাংলাদেশে খরগোশকে সাধারণতশখের বা পোষা প্রাণি হিসেবে পালন করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে খরগোশ পালন করা হচ্ছে। খরগোশের মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। বিলাসবহুল হোটেলরেস্তোরা এবং বড় বড় ভোজসভায় এদের মাংসের যথেষ্ট সমাদর আছে। খরগোশের মাংসে প্রোটিন,শক্তিমিনারেল ইত্যাদির পরিমান বেশি এবং ফ্যাটসোডিয়াম এবং কোলেষ্টেরল এর পরিমাণ কম। তাছাড়া গৃহপালিত প্রাণি হিসেবে খরগোশ পালনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক আয়ের প্রচুর সম্ভবনা রয়েছে। খরগোশের মাংস একদিকে যেমন প্রাণিজ আমিষের একটি চমৎকার উৎস হতে পারেঅন্যদিকে অভাবগ্রস্থ মহিলা ও বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের একটি বিরাট উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। 

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে দিন

Comments are closed.

© All rights reserved © 2014 Ajkerkrishi.com