শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০২:৪৪ অপরাহ্ন

আধুনিক পদ্ধতিতে পাহাড়ে চাষাবাদ

  • লাস্ট আপডেট : মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭
  • ১৭৬ টাইম ভিউ
WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

দেশের এক-দশমাংশ পাহাড়ি অঞ্চল। আর এ পাহাড়ি অঞ্চলে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে ভূমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা একই সঙ্গে কর্মসংস্থান ও ফসলের ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় পাহাড়ের ঢালে গাছ-গাছালি কেটে ও আগুনে পুড়িয়ে জমিকে চাষ উপযোগী করার মাধ্যমে যে চাষাবাদ করা হয়, তাই হচ্ছে জুম চাষ। জুম চাষকে পাহাড়ি সমপ্রদায় বিভিন্ন নামে অভিহিত করে। চাষ পদ্ধতি একই। জুম চাষকে চাকমা ভাষায় জুম, মারমা ভাষায় ইয়াঁ, ত্রিপুরা ভাষায় হুগ, ম্রো ভাষায় উঃঅ, খিয়াং ভাষায় লাই, বম ভাষায় লাও, কৃষিবিজ্ঞানিদের ভাষায় স্থানান্তরিত। পাহাড়িরা যুগ যুগ ধরে এ সনাতন পদ্ধতিতে পাহাড়ে জুম চাষাবাদ করে আসছে। এর মাধ্যমেই জুমিয়ারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় ১৮১৮ সালে জুম চাষ একমাত্র কৃষি ব্যবস্থা ছিল। এরপর ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতবাড়ির খাজনা প্রথা শুরু হয়। ১৮৭০ সালে এটিকে জুম খাজনা করা হয়। প্রতি পরিবার থেকে তখন ৪ টাকা খাজনা আদায় করা হতো। কৃষি বিভাগের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় অবস্থিত ৫ হাজার ৪৮০ বর্গকিলোমিটার অশ্রেণীভুক্ত বনভূমির সিংহভাগই জুম চাষ করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ৩০-৩৫ হাজার জুমিয়া পরিবার এ জুম চাষের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে রাঙামাটিতে ৯-১১ হাজার, খাগড়াছড়িতে ১০-১২ হাজার ও বান্দরবানে ১১-১৩ হাজার (তথ্য: জুম চাষ বই)। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শতকরা ৮০ ভাগ জুম চাষ করে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য়ের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম। ১৩,৩১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। দেশের এক-দশমাংশ আয়তনের এ পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েছে-রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা। তিন পার্বত্য জেলায় ২৫টি উপজেলা রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, উত্তর-পূর্বে ভাতের মিজোরাম রাজ্য, দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার (বার্মার) আরকান প্রদেশ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলা। দেশের সব ক’টি ধর্মের লোক পাওয়া যায় এ অঞ্চলে। বাংলা ভাষা-ভাষির জনগোষ্ঠী ছাড়াও ভিন্ন ভাষার অনেক উপজাতি সমপ্রদায় বসবাস করে এ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যা দেশের কোথাও আর দেখা যায় না। তাছাড়া পাহাড়ি-চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, বোম, খুমি, খ্যাং, চাক, তঞ্চঙ্গা, লুসাই-কুকি, রিয়াং, উসাই, পাংগো ছাড়াও বিভিন্ন উপজাতি বসবাস করে।

আরও পড়ুন  ঠেকাতে হবে মৎস্য মাফিয়া, কারেন্ট জাল

পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা জুম চাষ করে। জুমিয়া পরিবারগুলো তাদের এ ঐতিহ্যবাহী জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও আদি পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে এ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রাকৃতিক পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে পাহাড়গুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। জুমচাষে প্রতিবছর অসংখ্য পাহাড়ের গাছপালা বন-জঙ্গল কেটে আগুনে পোড়ানোর ফলে সবুজ অরণ্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে হারিয়ে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন্যপ্রাণির অস্তিত্ব। প্রতিবছর নতুন নতুন পাহাড় বেছে নিতে হয়, স্থান পরিবর্তন করে পাহাড়ের ঢালে চাষাবাদ করতে হয়।

উপজাতীয় জুমিয়া পরিবারগুলো জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচিত পাহাড়ের বন-জঙ্গল কেটে রোদে শুকায়। প্রায় মাসখানেক রোদে শুকানোর পর আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলে। ওই পাহাড়ে গাছপালা বলে কিছু থাকে না। শুধু ছাই আর গাছপালার পোড়া অবশিষ্টাংশ। জুমিয়া পরিবারগুলো বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে। ভারী বৃষ্টি হওয়ার পর পাহাড়ের মাটি খুড়ে রোপণ করে বিভিন্ন ফসল। প্রতিটি গর্তে বিভিন্ন ফসলের বীজ রোপণ করে জুমিয়ারা। নানাজাতের ধান, কুমড়া, মারফা, অড়হড়, শিম, শশা, করলা, ঢেঁড়শ, তিল, কা, ভুট্টা, আদা, যব, তুলা, হলুদ, পাহাড়ি আলু, শাবাং (সবজির নাম), জুমিয়া কচু, মাকসহ বিভিন্ন ফসলের বীজ রোপণ করে। জুমিয়াদের ভাষায়

ধান করলে ধান পায়,
জুম করলে সব পায়।

জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত জুমের ফসল ঘরে ওঠাতে থাকে। তখন জুমের জমিতে জুমিয়ারা মাচাং ঘর করে এবং সপরিবারে সেখানে বাস করে। কারণ এ সময় হরিণ, বানর, হাতি, বন্য শূকর এছাড়া বিভিন্ন বন্যপ্রাণি দ্বারা ফসলের ক্ষতি পারে। ফসল সংগ্রহ শেষ হলে আবার নতুন করে পাহাড় খোঁজা শুরু করে জুমিয়ারা। এভাবে সুদীর্ঘকালব্যাপী এ ভূমিহীন উপজাতীয় জুমিয়া পরিবারগুলো ঘুরে বেড়ায় যাযাবরের মতো এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে।

অপরিকল্পিতভাবে চাষাবাদ বিশেষ করে জুম চাষের জন্য দায়ী। ১৯৯২ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়-খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান জেলার পাহাড়ি ভূমি ক্ষয়ের হার খুব বিপজ্জনক মাত্রায় বেড়েছে। রামগড় কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, এক ইঞ্চি উর্বর মাটি তৈরি হতে প্রায় ১০০-১৫০ বছর সময় লাগে। অন্যদিকে অপরিকল্পতভাবে চাষাবাদ ও জুম চাষের ফলে পাহাড় ধ্বংস হয়ে এ উর্বর মাটি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি মাটি ক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান যেমন-ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, নাইট্রোজেন, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

আরও পড়ুন  ডেইরি ফার্ম

এসব কারণে পাহাড়ে গাছপালা বেঁচে থাকা দুরূহ হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। জুমচাষের কারণে পাহাড় ধসে অনেক সময় আসা-যাওয়ার রাস্তা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। নদী-নালা, খাল-বিল দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে কাপ্তাই হ্রদের গভীরতা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। জুমচাষ এক পাহাড়ে করার পর ১০-১৫ বছর আর সেই পাহাড়ে চাষাবাদ করা যায় না। তাছাড়া ওই পাহাড়ে ফসল আর ভালো ফলে না।

জুম জমির মাটি পাহাড়িদের জন্য খুবই গুরুত্ব বহন করে। কেননা, চাকমা ও তংচঞ্চা পাঙ্গপূজার বেদীমূলে পূজার উপকরণ হিসেবে জুম মাটির প্রয়োজন হয় বলে জানালেন কয়েকজন পাহাড়ি। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চাষাবাদও বদলিয়েছে। চাষীরা এখন ব্যবহার করছে উচ্চফলনশীল হাইব্রিড বীজ, আইপি এম প্রযুক্তি, আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি আরো অধিক উন্নত প্রযুক্তি। সেই যুগে জুম চাষ করে লাভবান হচ্ছে না জুম চাষীরা।

এমন অবস্থায় জুমীয়দের কথা বিবেচনা করে পাহাড়ের জন্য বিকল্প চাষ পদ্ধতি আবিষ্কৃৃত হয়েছে। তার নাম ম্যাথ্ (গড়ফধৎহ অমৎরপঁষঃঁৎধষ ঞবপযহড়ষড়মু রহ ঃযব ঐরষষ) পদ্ধতি। এ মডেল অনুসরণ করে চাষাবাদ করলে পাহাড়ি কৃষকদের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব। এছাড়া এ পদ্ধতিতে উর্বরতা বিনষ্ট হয় না। মাটির ক্ষয়রোধ হয়। ফসলের পর্যায়ক্রম অনুসারে চাষাবাদ করা যায়। ম্যাথ পদ্ধতিতে ধাপে ধাপে ফসলের চাষ করতে হয়। প্রথম বৃষ্টির পর পরই দ্রুত বর্ধনশীল ফসল-পেঁপে, কলা, পেয়ারা, লেবু, আম, সফেদা, জাম্বুরা, কমলা পাশাপাশি কিছু বনজ চারা লাগিয়ে দিতে হয়। সময় উপযোগী-আড়াআড়িভাবে আনারস, অড়হড়, লাগাতে হয়। তাছাড়া মৌসুমভিত্তিক ধান, কাউন, ভুট্টা, তিল, কচু, ঢেঁড়শ, বরবটি, টমেটো, বেগুন ও মরিচের চাষাবাদ করা যেতে পারে। ম্যাথ পদ্ধতিতে চাষ করলে কৃষকরা সবজির দাম তুলনামূলক বেশি পাবে। কেননা এ সবজি অমৌসুমে পাওয়া যায়। এতে অর্থনৈতিক উন্নতি হবে, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে, ভূমির ক্ষয়রোধ বন্ধ হবে। স্থায়ীভাবে বনায়ন সৃষ্টির ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ হবে। ম্যাথ পদ্ধতি পাহাড়ি অঞ্চলে গ্রহণযোগ্য হবে এবং কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে দিন

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
একই রকম পোস্ট