আজ রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:২৫ অপরাহ্ন
আমাদের দেশে পেয়ারা একটি জনপ্রিয় ফল। এটি ভিটামিন-সি আর ময়েশ্চারসমৃদ্ধ ফল। মোটামুটি সব ধরনের খাদ্যগুণ-ই পেয়ারাতে বিদ্যমান। পেয়ারা একটি খুব সাধারণ ও সহজলভ্য ফল। একটি পেয়ারাতে সমান আকৃতির একটি কমলার ৪ গুন এবং একটি লেবুর ১০ গুন বেশি ভিটামিন সি রয়েছে।পেয়ারার বিভিন্ন রোগবালাই
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে পেয়ারা চাষ করা হচ্ছে। কিন্তু এই পেয়ারা চাষ করার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে পেয়ারা গাছ এবং ফল অনেক রোগের আক্রমণের শিকার হয়। আসুন জেনে নেই পেয়ারার কিছু রোগ ও তাঁর প্রতিকার।
১। সাদা মাছি – সাদা মাছি পোকা পাতার নিচের দিকে আক্রমণ করে রস চুষে খায়। এর ফলে পাতায় সুটিমোল্ড ছত্রাক জন্মে এবং পাতা ঝরে যায়।
২। ফল ছিদ্রকারী পোকা- ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ হলে ফলের গায়ে কোথাও না কোথাও ছিদ্র হয়, ফল বিকৃত হয়ে যায়, ছিদ্রের মুখ দিয়ে পোকার মল পড়তে থাকে। কিন্তু ফলের মাছি পোকা আক্রমণ করলে গায়ে কোনো ছিদ্র হয় না, ফলও বিকৃত হয় না, রঙও ঠিক থাকে। শুধু ভেতরটা নষ্ট হয়ে যায়।
৩। ছাতরা পোকা- এ দেশের অধিকাংশ পেয়ারা গাছেই ছাতরা পোকা দেখা যায়। আক্রান্ত ডাল বা পাতায় এরা দল বেঁধে আঁকড়ে থাকে। সাদা রংয়ের এ পোকাগুলিকে দেখতে অনেকটা সাদা ছাতা বা তুলার মত দেখায়। এরা কচি পাতা, বিটপ, প্রশাখা এমনকি ফুল থেকেও রস চুষে খেতে থাকে। ফলে আক্রান্ত অংশ শুকিয়ে যায় এবং ফলন হ্রাস পায়।
৪। হোয়াইট ফ্লাই- হোয়াইট ফ্লাই এটিও ছাতরা পোকার মত প্যাঁজা তুলার ন্যায় পাতার নিচে জমে এবং পাতা চুষে খেয়ে মেরে ফেলে।
৫। ফোস্কা রোগ- এ রোগে আক্রান্ত হলে গাছে প্রথম ডগামরা লক্ষণ দেখা যায়। শাখা-প্রশাখা, বিটপ, পাতা ও ফল এ রোগে আক্রান্ত হয়। ফল ছাড়া অন্যান্য অংশ দ্রুত ডগার দিক থেকে শুকিয়ে গাঢ় বাদামী হয়ে আসতে থাকে। ঠান্ডা ও উষ্ণ-শুষ্ক উভয় আবহাওয়ায় এ রোগের প্রকোপ দেখা যায়। ফল আক্রান্ত হলে তাতে ফোস্কা ধরনের কাল দাগ পড়ে।
৬। উইল্ট (নেতানো)- অম্লীয় মাটিতে জন্মানো পেয়ারা গাছে এ রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করে। এ রোগের প্রকোপে প্রথমে পাতা হলুদ হয়ে আসে এবং পরে শুকিয়ে যায়। এভাবে পাতার পর প্রশাখা এবং ক্রমান্বয়ে সারা গাছই ১০-১৫ দিনের মধ্যে নেতিয়ে পড়ে।
৭। দয়ে পোকা (ডরসিকা ম্যাঙ্গিফেরা ও প্ল্যানোকাক্কাস সিট্রি)- দয়ে পোকার পূর্ণাঙ্গ ও অপূর্ণাঙ্গ দশা গাছের সবুজ অংশের রস শোষণ করে এবং সাদা আঁশের মতো আচ্ছাদন সৃষ্টি করে। দয়ে পোকা আক্রান্ত গাছের অংশ শুকিয়ে যায়। পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী পোকা এপ্রিল-মে মাসে গাছ থেকে নেমে মাটিতে ডিম পাড়ে ও ডিসেম্বর পর্যন্ত মাটিতেই থাকে।
৮। পেয়ারা ঢলে পড়া- বর্ষার শেষ দিকে গাছের ডালের আগার দিক থেকে পাতা হলদে হয়ে ঝরে পড়ে। ডালসহ গাছ আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়। বয়স্ক গাছে এই ছত্রাকজনিত রোগটি বেশি হয়।
৯। ফলের গায়ে উঁচু দাগ- ছত্রাকজনিত খসখসে উঁচু বাদামি বা মরচে দাগ হয়।
এছাড়াও পেয়ারা গাছ বিভিন্ন ধরণের রোগে আক্রান্ত হয়। যেমন পেয়ারা গাছের পাতা, কান্ড, শাখা-প্রশাখা ও ফল এ্যানথ্রাকনোজ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। প্রথমে পেয়ারা গাছে ছোট ছোট বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়। দাগগুলো ধীরে ধীরে বড় হয়ে পেয়ারা গাছে ক্ষত সৃষ্টি করে।
আক্রান্ত ফল পরিপক্ক হলে অনেক সময় ফেটে যায়। তাছাড়া এ রোগে আক্রান্ত ফলের শাঁস শক্ত হয়ে যায়। গাছের পরিত্যক্ত শাখা-প্রশাখা, ফল এবং পাতায় এ রোগের জীবাণু বেঁচে থাকে। বাতাস ও বৃষ্টির মাধ্যমে পেয়ারার এ্যানথ্রাকনোজ রোগ ছড়ায়।
১। সাদা মাছি – সাদা মাছি দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে পাঁচ গ্রাম ডিটারজেন্ট পাউডার মিশিয়ে গাছে স্প্রে করা।
২। ফল ছিদ্রকারী পোকা- এ অবস্খায় ম্যালথিয়ন ৫৭-ইসি বা ফেনিট্রথিয়ন প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০ মিলিলিটার পরিমাণ মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে। গাছের নিচে ঝরে পড়া কোনো ফল রাখা চলবে না। অথবা ছত্রাকনাশক যেমন কার্বসালফান ২৫% ইসি (২ মিলি প্রতি লিটার জলে) অথবা ট্রায়াজোফস ৪০% ইসি (১ মিলি প্রতি লিটার জলে) স্প্রে করতে হবে।
৩। ছাতরা পোকা- যদি আক্রমণের মাত্রা কম থাকে তবে আক্রান্ত অংশ কেটে পুড়িয়ে ফেলা ভাল। আক্রান্ত হলে ২০ মিলি ম্যালথিয়ন ৫৭ ইসি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
৪। হোয়াইট ফ্লাই- প্রতি লিটার পানিতে ১০ গ্রাম ডিটারজেন্ট পাউডার মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
৫। ফোস্কা রোগ- এ রোগের প্রতিকার করতে হলে প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত অংশের কালো দাগ সরিয়ে ফেলতে হবে। অতঃপর (৪:৪:৫০) বোর্দোমিশ্রণ বা ডাইথেন এম-৪৫ গাছে স্প্রে করতে হবে।
৬। উইল্ট (নেতানো)- উইল্ট প্রতিরোধী জাতের উপর জোড় কলম করে এ রোগ দমন সম্ভব।
৭। দয়ে পোকা (ডরসিকা ম্যাঙ্গিফেরা ও প্ল্যানোকাক্কাস সিট্রি)- নিয়মিত বাগান পরিষ্কার রাখা ও আগাছামুক্ত রাখা। গ্রীষ্মকালীন চাষ দেওয়া, এতে রোদের তাপে মাটিতে অবস্থিত ডিম নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়াও খুব বেশি আক্রমণ দেখা দিলে কীটনাশক যেমন অ্যাসিফেট ৭৫% ডব্লুপি (০.৭৫ গ্রাম প্রতি লিটার জলে) অথবা ডাইমিথোয়েট ৩০% ইসি (২ মিলি প্রতি লিটার জলে) স্প্রে করতে হবে।
৮। পেয়ারা ঢলে পড়া- সঠিক প্রতিকার অজানা। জৈবসার প্রয়োগ, সুষম সার ব্যবহার ও মাটিতে জল জমতে না দিলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব কম হয়। মাটির অম্লত্ব বা ক্ষারত্ব খুব বেশি হলে প্রশমিত করা প্রয়োজন। এ ছাড়াও বর্ষার আগে জৈব ছত্রাকনাশক জৈবসারের সাথে মিশিয়ে (২৫০ গ্রাম ট্রাইকোডারমা ভিরিডি) প্রতি গাছের গোড়ায় দিলে উপকার পাওয়া যায়।
৯। ফলের গায়ে উঁচু দাগ- কার্বেন্ডাজিম যেমন ব্যভিষ্টিন, ফরাস্টিন, এমকোজিন, নোইন (১ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে) স্প্রে করতে হবে।
সাধারণ যে সকল রোগে পেয়ারা গাছ আক্রান্ত হয় সেগুলোর সঠিক রোগ নির্ণয় করে সঠিক কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। পেয়ারা বাগান নিয়মিত পরিদর্শনে যেতে হবে। বিশেষ করে পেয়ারা ডাসা হওয়া শুরু করলে রোজই একবার গিয়ে গাছের তলায় দেখতে হবে।
কোনো পেয়ারা সেখানে পড়ে থাকলে ছুরি দিয়ে দোফালা করে পোকার আক্রমণ হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করতে হবে। যদি ঝরে পড়া পেয়ারা না পাওয়া যায় তাহলে গাছে পেকে ওঠা বা রঙ ধরা পেয়ারা দু-একটা ছিঁড়ে কেটে তার ভেতরটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। পোকার আক্রমণ দেখা গেলে দেরি না করে বাকি কাঁচা ফলগুলোকে ফলের মাছি পোকার আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্খা নিতে হবে।