মুড়ি ও চিড়া তৈরি ব্যবসা কিভাবে শুরু করবেন
ভুমিকা
প্রধান খাদ্য ভাতের পাশাপাশি মুড়ি ও চিড়া মুখরোচক খাবার হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। নতুন ধান কাটার পর বাড়িতে পিঠা তৈরির পাশাপাশি চিড়া ও মুড়ি তৈরির ধুম পড়ে যায়। গ্রামের বাড়িতে অতিথি আসলে অনেক সময় মুড়ি চিড়া দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। আবার শহরের বাড়িতেও মুড়ি, চিড়ার কদর কোনো অংশে কম নয়। রোজার মাসে ইফতারিতে মুড়ি ও চিড়া বেশ জনপ্রিয় খাবার। মুড়ি-চিড়া অনেক দিন ভালো থাকে এবং এগুলো তৈরি করে সরাসরি ফেরি করেও বিক্রি করা যায়। এছাড়া বিভিন্ন দোকানেও সরবরাহ করা সম্ভব।
গ্রাম বা শহর যেকোন জায়গাতে ছোট বড় সবার কাছেই মুখরোচক খাদ্য হিসেবে মুড়ি ও চিড়ার চাহিদা আছে। অল্প পুঁজিতে মুড়ি ও চিড়ার ব্যবসা বেশ লাভজনক। মুড়ি চিড়ার ব্যবসা করে যেকোন ব্যক্তি স্বাবলম্বী হতে পারেন। ভাতের বিকল্প বা নাস্তা হিসেবে মুড়ি ও চিড়া সাধরণত গুঁড়, চিনি, ফলমূল বা অন্য কোন মিষ্টি জাতীয় দ্রব্যের সাথে খাওয়া হয়। চিড়ার পায়েস অনেকেই বেশ পছন্দ করে। মুড়ি ও চিড়ার সাথে গুড় মিশিয়ে মোয়া তৈরি করা হয়। মশলা মেশানো চিড়া ভাজা বা মুড়ি মাখানো সবার কাছেই বেশ প্রিয়। এছাড়া কাঁঠাল ও আমের সাথে মিশিয়েও মুড়ি ও চিড়া খাওয়া হয়ে থাকে।
বাজার সম্ভাবনা
প্রধান খাদ্য ভাতের পাশাপাশি মুড়ি ও চিড়া মুখরোচক খাবার হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। মুড়ি ও চিড়া তৈরি আমাদের গ্রামীণ সমাজ ও সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। নতুন ধান কাটার পর বাড়িতে পিঠা তৈরির পাশাপাশি চিড়া ও মুড়ি তৈরির ধুম পড়ে যায়। গ্রামের বাড়িতে অতিথি আসলে অনেক সময় মুড়ি চিড়া দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। আবার শহরের বাড়িতেও মুড়ি, চিড়ার কদর কোন অংশে কম নয়। রোজার মাসে ইফতারীতে মুড়ি ও চিড়া বেশ জনপ্রিয় খাবার।
মূলধন
আনুমানিক ১৫০০-২০০০ টাকার স্থায়ী উপকরণ এবং ৫০০-৬০০ টাকার কাঁচামাল কিনে মুড়ি-চিড়া তৈরি ব্যবসা শুরু করা সম্ভব। মুড়ি-চিড়া তৈরি ব্যবসা শুরু করতে যদি নিজের কাছে প্রয়োজনীয় পুঁজি না থাকে তাহলে স্থানীয় ঋণদানকারী ব্যাংক (সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক) বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (আশা, গ্রামীণ ব্যাংক, ব্রাক, প্রশিকা) থেকে শর্ত সাপেক্ষে স্বল্প সুদে ঋণ নেয়া যেতে পারে।
প্রশিক্ষণ
মুড়ি বা চিড়া তৈরির জন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দরকার নেই। মুড়ি-চিড়া তৈরি দেখে দেখেই শেখা সম্ভব। অভিজ্ঞ কারো কাছ থেকেও এ ব্যাপারে ধারণা নেওয়া যেতে পারে।
প্রয়োজনীয় উপকরণ, পরিমাণ, মূল্য ও প্রাপ্তিস্থান
স্থায়ী উপকরণ
স্থায়ী উপকরণ
উপকরণ | পরিমাণ | আনুমানিক মূল্য (টাকা) | প্রাপ্তিস্থান |
বড় কড়াই | ১টি | ৫০০-৫২০ | তৈজসপত্রের দোকান |
কুলা | ১টি | ২৫-২৮ | মুদি দোকান |
মাটির হাড়ি (চাল গরম করার জন্য) | ১টি | ৩০-৩২ | মাটির পণ্য বিক্রির দোকান |
মাটির হাড়ি (বালু গরম করার জন্য) | ১টি | ৩০-৩২ | মাটির পণ্য বিক্রির দোকান |
ঝাঁজরি (মাটির) | ১টি | ৩০-৩২ | মাটির পণ্য বিক্রির দোকান |
টিনের কৌটা | ১টি | ২০-২৫ | হাড়ি পাতিল বিক্রির দোকান |
চুলা (মাটির) | ২টি | নিজেই তৈরি করে নেয়া যায় | — |
ঢেঁকি/ধানের কল | ১টি | ———- | চালের মিল |
মোট=৬৩৫-৬৬৯ টাকা |
কাঁচামাল
উপকরণ | পরিমাণ | আনুমানিক মূল্য (টাকা) | প্রাপ্তিস্থান |
ধান | ১০ কেজি | ১৫০-২০০ | ধানের হাট |
পানি (ভেজানোর জন্য সিদ্ধ) | ——– | ———— | ——– |
লবণ | ৭৫ গ্রাম | ২-৪ টাকা | মুদি দোকান |
বালু | পরিমাণ মত | ———— | বালি বিক্রির দোকান/
বিনামূল্যেও যোগাড় করা যায় |
মোট=১৫২-২০৪ টাকা |
চিড়া তৈরি খরচ
চিড়া তৈরিতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও বাসনপত্র
উপকরণ | পরিমাণ | আনুমানিক মূল্য (টাকা) | প্রাপ্তিস্থান |
বড় কড়াই | ১টি | ৫০০-৫৫০ টাকা | তৈজসপত্রের দোকান |
কুলা | ১টি | ২৫-৩০ টাকা | মুদি দোকান |
মাটির হাড়ি | ২টি | ৬০-৭০ টাকা | মাটির পণ্য বিক্রির দোকান |
বাঁশের ঝুড়ি/বেতের ধামা | ১টি (বড়) | ১৫০-১৭০ টাকা | হাটে বা বাজারে নির্দিষ্ট দোকান |
ঢেঁকি | ১টি | ৫০০-৮০০ টাকা | কাঠ মিস্ত্রি দিয়ে তৈরি করে নেয়া যায় |
চুলা | ১টি | ———– | নিজে তৈরি করা যায় |
মোট=১২৩৫-১৬২০ টাকা |
চিড়া তৈরির কাঁচামাল
উপকরণ | পরিমাণ | আনুমানিক মূল্য (টাকা) | প্রাপ্তিস্থান |
ধান | ১০ কেজি | ১৫০-২০০ টাকা | ধানের হাট |
লবণ | ৭৫ গ্রাম | ২-৪ টাকা | মুদি দোকান |
পানি | পরিমাণ মত | ———— | ————– |
মোট=১৫২-২০৪ টাকা |
মুড়ি তৈরির নিয়ম
- মুড়ি ভাজার উপযোগী ধান বেছে নিতে হবে। (যেমন-মালা/বিরই ইত্যাদি ধান)।
- ধানগুলো একটি বড় পাত্রে (কড়াই, পাতিল, ব্যারেল, হাফ ড্রাম) সমান সমান পানি দিয়ে সেদ্ধ করতে হবে ।
- যতক্ষণ পর্যন্ত দু’একটি ধান ফেটে চাল না বের হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সেদ্ধ করতে হবে।
- ধান সিদ্ধ হলে অন্য একটি পাত্রে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
- পরদিন সকালে ধানগুলো আবার সেদ্ধ করতে হবে।
- এর পর ধানগুলো পানি থেকে ছেঁকে নিয়ে পরিস্কার একটি স্থানে বা চাতালে ছড়িয়ে দিতে হবে। কড়া রোদে দিলে এক দিনেই ধান শুকিয়ে যায়।
- শুকনো ধানগুলো ঢেঁকিতে ভাঙ্গাতে হবে যেন খোসাগুলো আলাদা হয়ে যায়। অথবা ধানভাঙ্গার মেশিনেও চাল তৈরি করা যায়।
- এবার কুলায় ঝেড়ে চালগুলো খোসা (তুষ) থেকে আলাদা করে ফেলতে হবে।
- মুড়ি ভাজতে ২টি চুলা দরকার হয়। একটি চুলায় চালগুলো অনবরত নাড়তে হয় যেন সেগুলো বাদামী হয়ে যায়। অন্য চুলায় বালি গরম করতে হয়। চুলায় দেওয়ার আগে চালগুলোতে লবণ ও সামান্য পানি মাখিয়ে নিতে হবে।
- চাল উত্তপ্ত হয়ে যে সময় দুই একটি ফুটতে থাকবে তখন গরম বালির পাত্রে চালগুলো ঢেলে দিয়ে ক্রমাগতভাবে নাড়তে হবে। এভাবে নাড়তে থাকলে সবগুলো চাল ফুটে যাবে।
- চাল ফোটা শেষ হলে চালুনী বা ছিদ্রযুক্ত পাত্রে ঢেলে নাড়া দিলে মুড়িগুলো বালি থেকে আলাদা হয়ে যাবে।
চিড়া কোটা
মুড়ির মত চিড়ার জন্যও বিশেষ ধরণের চাল লাগে। চিড়ার ধান তৈরি করাও একটি বিশেষ কৌশল। গ্রামের মেয়েরা তাদের মা- চাচীদের কাছ থেকে এগুলো শিখে থাকে। এক জনের নিকট থেকে আরেকজন শেখে, এভাবেই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। চোখে দেখে, আন্দাজ করে, গন্ধ শুঁকে এবং সাধারণ বুদ্ধি প্রয়োগ করে চিড়া কুটতে হয়।
চিড়া তৈরির নিয়ম
- চিড়ার উপযোগী ধান নির্বাচন করতে হবে।
- একটি বড় পাত্রে ডুবন্ত পানিতে ধান ভিজিয়ে রাখতে হবে।
- পরদিন সকালে ধানগুলো সেদ্ধ করতে হবে। দুএকটি ধান ফেটে গেলে বুঝতে হবে সেদ্ধ হয়েছে।
- ধানগুলো বেতের ধামায় রেখে পানি ঝরাতে হবে।
- এবার এই ধানগুলো রোদে না শুকিয়েই চিড়া বানানোর প্রস্ত্ততি নিতে হবে।
- মাটি বা লোহার তৈরি কড়াই-এ ধান বালি ছাড়াই ক্রমাগত নেড়ে ভাজতে হবে।
- দু’একটি ধান ফুটতে থাকলে কড়াই থেকে নামিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঢেঁকিতে কুটতে হবে। সব ধান থেকে চাল বের হয়ে ভালোভাবে চেপ্টা না হওয়া পর্যন্ত কুটতে হবে এবং মাঝে মাঝে হাতে তুলে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
- কোটা শেষ হলে কুলায় ঝেড়ে তুষ ও কুড়া আলাদা করে নিতে হবে।
- চিড়া ভাজতে একজন আর ঢেঁকিতে পাড় দিতে আরো ২ জন লোক দরকার হয়।
বর্তমানে মেশিনে চিড়া তৈরি হয়। তবে ঢেঁকিতে তৈরি চিড়ার স্বাদ ও পুষ্টি বেশি থাকে।
সতর্কতা
মুড়ি ও চিড়া তৈরির পর খোলা পাত্রে রেখে দিলে তা নরম হয়ে যায়। বিশেষ করে মুড়ি মচমচে না হলে তা বাজারে বিক্রি করা যাবে না। এজন্য মুড়ি ও চিড়া তৈরির পরই তা মুখ বন্ধ পাত্রে রেখে দিতে হবে। বিক্রির জন্য ৫০০ গ্রাম, এক কেজি ইত্যাদি বিভিন্ন মাপে মেপে প্যাকেট করে রাখা যেতে পারে। বায়ুশুন্য পলি প্রপাইলিন প্যাকেটে সংরক্ষণ করে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে।
আনুমানিক আয় ও লাভের পরিমাণ
মুড়ি
১০ কেজি ধান থেকে আনুমানিক ৫ কেজি চাল পাওয়া যায় এবং প্রায় ৫ কেজি চাল থেকে আনুমানিক প্রায় ৫ কেজি মুড়ি বা চিড়া তৈরি করা যেতে পারে।
খরচ
স্থায়ী উপকরণ বাদে ৫ কেজি মুড়ি তৈরিতে খরচ=১৫০-২০০ টাকা
১ কেজি মুড়ি তৈরিতে খরচ |
৩০-৪০ টাকা |
জ্বালানী বাবদ |
৫-৬ টাকা |
মোট=৩৫–৪৬ টাকা |
আয়
১ কেজি মুড়ির বিক্রয় মূল্য=৫০-৫৫ টাকা
লাভ
১ কেজি মুড়ির বিক্রয় মূল্য |
৫০-৫৫ টাকা |
১ কেজি মুড়ি তৈরিতে খরচ |
৩৫-৪৬ টাকা |
লাভ=১৫-৯ টাকা |
অর্থাৎ লাভ ৯-১৫ টাকা। তবে সময় ও স্থানভেদে এর কম বা বেশি লাভ হতে পারে।
চিড়া
খরচ
৫ কেজি চিড়ার কাঁচামালের খরচ হয় ১৫২-২০৪ টাকা
১ কেজি চিড়া তৈরিতে খরচ ৩১-৪১ টাকা
আয়
১ কেজি চিড়ার বিক্রয় মূল্য |
৪০-৪৫ টাকা |
১ কেজি চিড়া তৈরিতে খরচ |
৩১-৪১ টাকা |
লাভ=৯-৪ টাকা অর্থাৎ লাভ ৪-৯ টাকা। তবে সময় ও স্থানভেদে এর কম বা বেশি লাভ হতে পারে। |
মুড়ি-চিড়া অনেক দিন ভালো থাকে এবং এগুলো তৈরি করে সরাসরি ফেরী করেও বিক্রি করা যায়। এছাড়া বিভিন্ন দোকানেও সরবরাহ করে ব্যবসা চালিয়ে নেয়া সম্ভব।