ভূমিকা
আদিকাল থেকে মৌমাছি মানুষের নিকট অতি পরিচিত এক প্রকার ক্ষুদ্র, পরিশ্রমী ও উপকারী পতঙ্গ। সাধারণত দলবদ্ধভাবে বাস করে বলে এদেরকে সামাজিক পতঙ্গ বলা হয়। মৌমাছি থেকে আমরা মধু ও মোম পাই। মৌমাছিরা ফুলের পরাগায়ন ঘটিয়ে বনজ, ফলদ ও কৃষিজ ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। কোন কোন প্রকার মৌমাছি বাক্সবন্দী করে লালন-পালন বা চাষ করা যায়। এবং অধিকতর লাভবান হওয়া যায়।
মৌমাছির প্রজাতি
আমাদের দেশে সাধারণত তিন প্রজাতির মৌমাছি পাওয়া যায়, যথা:
- পাহাড়ী মৌমাছি,
- ভারতীয় মৌমাছি ও
- ক্ষুদে মৌমাছি।
পাহাড়ী মৌমাছি : এরা আকারে সবচেয়ে বড়। বড় বড় গাছের ডালে, পাহাড়ের গায়ে এরা চাক বাঁধে। চাক প্রতি মধুর উৎপাদন প্রতিবারে গড়ে প্রায় ১০ কেজি। এরা পোষ মানে না তাই বাক্সে লালন-পালন করা যায় না।
ভারতীয় মৌমাছি : এরা আকারে মাঝারি ধরনের। অন্ধকার বা আড়াল করা স্থান গাছের ফোকর, দেওয়ালের ফাটল,আলমারি, ইটের স্তুপ ইত্যাদি স্থানে এরা চাক বাঁধে। চাক প্রতি মধুর উৎপাদন প্রতিবারে গড়ে প্রায় ৪ কেজি। এরা শান্ত প্রকৃতির। তাই বাক্সে লালন-পালন করা যায়।
ক্ষুদে মৌমাছি : এরা আকারে সবচেয়ে ছোট। এরা ঝোপ জাতীয় গাছের ডালে, পাতায় ও শুকনো কাঠি প্রভৃতিতে চাক বাঁধে। চাকার আকার খুব ছোট। বাঁধে। চাক প্রতি মধুর উৎপাদন প্রতিবারে গড়ে প্রায় ২০০ গ্রাম । এরা শান্ত প্রকৃতির। তবে এক স্থানে বেশিদিন থাকে ন।
মধু ও মোম
মধু একান্তভাবে মৌমাছির তৈরী এক প্রকার উপাদেয় খাদ্য। শ্রমিক মৌমাছিরা ফুলের মিষ্টি রস শুষে নেয় এবং তা জমা করে পাকস্থলীর উপরে এক বিশেষ অঙ্গে যাকে মধুথলি বলে। ফুলের মিষ্টি রস মধুথলিতে জমা করার সময় এর সঙ্গে লালা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন উৎসেচক মেশায়। এর ফলে মিষ্টি রস পরিবর্তিত হয়ে আংশিক মধু তৈরী হয়, যা চাকে এনে ঢেলে দেয় মধু রাখার খোপগুলোতে। তরুণ শ্রমিক মৌমাছিরা এ সময় ছুটে এসে ঐ মধু আবার মুখে ভরে এবং তাদের লালার সংগে মিশিয়ে তৈরী করে আসল মধু এবং তা জমা করে খোপে। শ্রমিক মৌমাছিরা জোরে ডানা নেড়ে খোপে রক্ষিত মধু থেকে বাড়তি পানি সরিয়ে দেয়। ফলে এক সময় ফুলের মিষ্টি রস হয়ে যায় ঘন মধু, যা জমা রাখে নিজেদের ও বাচ্চাদের খাবার হিসাবে। মধু জমা রাখার পর খোপগুলোর মুখ মোম দিয়ে বন্ধ করে দেয়। শ্রমিক মৌমাছির পেটের তলায় পকেটের মত ভাজ থাকে মোমগ্রন্থি। সেখানে তৈরী হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতের মত মোম কণা। এ মোম দিয়ে শ্রমিকেরা বানায় বাসা।
মৌমাছি সংগ্রহ ও কৃত্রিম খাবার
প্রকৃত থেকে ভারতীয় মৌমাছি (রাণী ও কিছু শ্রমিক) সংগ্রহ করে অথবা প্রতিষ্টিত মৌচাষীর নিকট থেকে ক্রয় করে মৌচাষ কার্যক্রম আরম্ভ করা হয়। বাক্সবন্দীর প্রথম ৩/৪ দিন কৃত্রিম খাবার যথা চিনির ঘন সরবত বা সিরাপ দেবার প্রয়োজন হয়। এরপর মৌমাছিরা নিজেদের খাবার নিজেরা সংগ্রহ করে থাকে। কখনো কখনো পরিবেশে খাবার ঘাটতি পড়লে ও কৃত্রিম খাবার দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
মধু সংগ্রহ
মধু সংগ্রহ করার সময় আস্ত চাক হাত দিয়ে চিপে মধু বের করা হয়। এ মধুতে মৌমাছির দেহাংশ ও বজ্য পদার্থ বিদ্যমান থাকে। এছাড়া এ ধরনের মধু অশ্প দিনের মধ্যে পচে নষ্ট হয়ে যায়। অপর দিকে বাক্সে লালন-পালন করা মৌমাছির চাক থেকে মধু নিষ্কাশন যন্ত্রের সাহায্য মধু বের করা যায়। এতে চাক থেকে শুধু মধু বের হয়ে আসে, অথচ চাক নষ্ট হয় না এবং তা আবার ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক মৌমাছি পালন কর্মসূচী
চট্রগ্রামস্থ বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের বন রক্ষণ বিভাগ ২০০০-২০০১ অর্থ বছরে “কৃষি গবেষণা ব্যবস্থাপনা প্রকল্প” এর আর্থিক সহায়তা অত্র প্রতিষ্ঠানের “খামার পদ্ধতি গবেষণা ও উন্নয়ন” কর্মসূচীর আওতায় মৌমাছি পালন কার্যক্রম গ্রহণ করে। এ কর্মসূচীর মাধ্যমে বান্ধরবান পার্বত্য জেলার মার্মা, মুরং, তংচইংগা, হিন্দু ও মুসলমান ও ফাইতং নামক তিনটি স্থানে মৌমাছি পালনকে একটি সম্ভাবনাময় ও লাভজনক কর্মকান্ড হিসাবে তুলে ধরার এক প্রয়াস নেওয়া হয়।
মৌমাছি পালনের উপকারী দিকসমূহ
দেশে খাটি মধুর চাহিদা পূরণ করে পুষ্ঠিহীনতা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ মধু শর্করা জাতীয় খাদ্য। যা বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন, এনজাইম ও খনিজ পদার্থ থাকে।
মধু রোগ (যথা: সর্দি, কাশি, বাত, ব্যাথা ইত্যাদি) জীবানুনাশক হিসাবে ব্যবহার করে।
মোম, মোমবাতি, প্রসাধন (কোল্ড ক্রীম, সেভিং ক্রীম, স্নো ইত্যাদি) ঔষধ বিভিন্ন মলম তৈরী ব্যবহার হযে থাকে।
মধু ও মোম বিক্রয় করে বাড়তি আয়ের সংস্থানের মাধমে পারিবারিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি করে যা সার্বিকভাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠির দারিদ্র্য দূরীকরনের সাহায্য করে।
ফুলের পরাগায়নের মাধ্যমে কৃষিজ, ফলদ ও বনজ গাছ-পালার ফলন ও গুণগতমান বৃদ্ধি করে ও জীব বৈচিত্রে সংরক্ষনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মৌমাছি পালনের আয়-ব্যয়
উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে মৌমাছি পালন করলে এবং এলাকায় পর্যাপ্ত সহায়ক গাছ-পালা থাকলে একটি বাক্স থেকে মধূ (শীতকালে) ৭/৮ কেজি এবং বছরে ১৮/২০ কেজি খাটি মধু সংগ্রহ করা যায়।
আয় :
উৎপাদিত মধু = ১৫ কজি
কেজি প্রতি টাকা ৩০০.০০ হিসেবে
মোট (১৫x৩০০.০০) = ৪,৫০০.০০
ব্যয়:
মৌমাছির বাক্সের দাম = টাকা ৭০০.০০
মৌমাছির দাম = টাকা ৭০০.০০
কৃত্রিম খাদ্য = টাকা ৫০.০০
অন্যান্য = টাকা ৫০.০০
মোট = টাকা ১,৫০.০০
লাভ:
= আয়-ব্যয়
= টাকা ৪,৫০০.০০
= টাকা ৩,০০০.০০
কেস স্টাডি:
মধুর ব্যবসায় ভাগ্য ফেরান ফাতেমা
জীবনের বাঁকে বাঁকে বহুমুখী প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে অবশেষে মধুর ব্যবসায় ভাগ্য ফেরানোর যুদ্ধে জয়ী কানিজ ফাতেমা। সংসার চালানো থেকে শুরু করে ছেলের লেখাপড়া পর্যন্ত সবকিছুই চলে মধুর ব্যবসায়। জীবনে সমস্যা অনেক থাকবে। তার পরও প্রশিক্ষণ নিয়ে এ পেশায় এসে যে কেউ সফলতার মুখ দেখতে পারেন বলে অভিমত ফাতেমার।
নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমে সফল নারী উদ্যোক্তা মধু ব্যবসায়ী কানিজ ফাতেমা গাজীপুর জয়দেবপুরে গড়ে তুলেছেন ‘মৌ মধুবন’ নামে মধু উৎপাদনের খামার। একক প্রচেষ্টায় যেমন ফিরিয়েছেন নিজের ভাগ্য, তেমনি তার প্রতিষ্ঠানে এখন কাজ করছেন অনেক মানুষ। খামারে কাজ করে ওই মানুষগুলোও পেয়েছেন বেঁচে থাকার পথ। কানিজ ফাতেমার জীবনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে সংগ্রামের ইতিহাস। অনেক কষ্ট করেও জীবনে যে সফলতার মুখ দেখা যায়, তার দৃষ্টান্ত হয়েছেন তিনি। শিক্ষা জীবনেই কিছু একটা করার মানসিকতা ছিল তার। সে কারণে ১৯৮২ সালে জয়দেবপুর সরকারি গার্লস স্কুলে দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালেই বাবামাকে না জানিয়ে বন্ধু–বান্ধবের সঙ্গে বিসিকের সহায়তায় মধু তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এই প্রশিক্ষণই দুর্দিনে তাকে মধু উৎপাদনের খামার প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিয়েছে।
ফাতেমা এসএসসি পাস করে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন জয়দেবপুর কাজী আজিম উদ্দিন কলেজে। সাফল্যের সঙ্গে ইন্টারমিডিয়েটও পাস করেন। ১৯৮৭ সালে খুলনার সিভিল ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বিয়ের পর ঢাকার মিরপুরে বাসা নিয়ে ফাতেমার নতুন জীবন শুরু হয়। ভালো চলছিল সংসার। ফাতেমার কোল জুড়ে আসে পুত্র সন্তান। নাম রাখা হয় শাহরিয়ার ফয়সাল। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয়া এই ছেলের মাত্র চার বছর বয়সেই মোশারফ হোসেনের মৃত্যু ঘটে। এর মধ্য দিয়ে ফাতেমার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। একদিকে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছেলে, অন্যদিকে সংসারের অভাব–অনটন। উভয় সঙ্কটে চোখে অন্ধকার দেখছিলেন ফাতেমা। নিরুপায় হয়ে ছেলেকে দেন এতিমখানায়। আর নিজে বেছে নেন আরেক সংগ্রামের পথ। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি খুঁজতে শুরু করেন ফাতেমা। এক এক করে একাধিক স্থানে কাজ করেন। কিন্তু কোনো স্থানেই বেশিদিন কাজ করা সম্ভব হয়নি। নিজেই একটা কিছু করার মানসিকতা থেকে ফাতেমা মাসিক রোজগার থেকে জমিয়ে ফেলেন ২০ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়েই নিজের জন্মস্থান জয়দেবপুরে মধু উৎপাদনের খামার করেন। এই খামার স্থাপনে কাজে লাগে তার সেই মধু তৈরির প্রশিক্ষণ। ২০ হাজার টাকায় ৪টি মধুর বাক্স ক্রয়ের মধ্য দিয়ে ফাতেমার জীবনে আরেক অধ্যায় শুরু। একটি দোকান ভাড়া নেন পাঁচ হাজার টাকায়। ফুলের মৌসুমে বাক্সগুলো বাগানের পাশে রেখে দিতেন। তাঁবু টাঙিয়ে সেগুলো পাহারা দেয়ার জন্য লোকও রাখেন। এভাবেই তার মধু উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। শুরুর দিকে নিজের হাতেই বাসায় মধু তৈরি করেন তিনি। এজন্য সরকারি–বেসরকারি সহযোগিতা পাননি। এভাবে পর্যায়ক্রমে ফাতেমার মধু উৎপাদন কার্যক্রম সম্প্রসারিত হতে থাকে।
মৌচাষে ভাগ্য বদলাচ্ছে আদিবাসী নারীরা
ক্রমেই উজাড় হচ্ছে শেরপুর ও জামালপুর জেলার গারো পাহাড়ের বনজঙ্গল। ফসলি জমিতে ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক। এতে মৌমাছির খাদ্য আর বাসস্থানের চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফলে হারিয়ে গেছে পরিশ্রমী বন্য মৌমাছি। মাত্র দু’যুগ আগেও আদিবাসী অধ্যুষিত এ গারো পাহাড় ছিল মৌমাছির অভয়ারণ্য। প্রায় ঘরেই দেখা যেত মধু, কিন্তু এখন তা বিলুপ্তির পথে।
মাত্র পাঁচ–ছয় বছর আগেও গারো পাহাড়ের মালাকোচা ডুমুরগাছ ও বালিজুরি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবনসহ বিভিন্ন স্থানে দেখা যেত শত শত মৌচাক। বছরে চার–পাঁচ মাস চলত মধু আহরণ। সে সময় মৌয়ালিদের ছিল পোয়াবারো। আজগর আলী, নিতেন মারাক, লবকোশ মারাকসহ ক’জন মৌয়ালির হিসাবমতে, গারো পাহাড় থেকে বছরে অন্তত এক হাজার লিটার মধু আহরণ করা হতো। এসব মধু স্থানীয়ভাবে চাহিদা মিটিয়েও দেশের বিভিন্ন স্থানে রফতানি হতো। সে সময় ছিল ফুল আর পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ। এজন্য গারো পাহাড়ের গ্রামগুলোতে দেখা যেত অসংখ্য মৌচাক। এখনও গৃহবধূরা বিশ্বাস করেন, যদি বাড়ির ওপর দিয়ে মৌমাছির দল উড়ে যায়, তাহলে ঢেঁকিতে পাড় দিতে হয়। ঢেঁকির শব্দে ওই বাড়িতে মৌচাক করে মৌমাছিরা। এমনকি ভালোমন্দ বা সুখ–দুঃখ বুঝেও মৌমাছি চাক করে বলে তাদের ধারণা। মৌমাছি আর মৌচাক এখন নতুন প্রজন্মের কাছে কবির কবিতার মতোই, যা এখন বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ। ভবিষ্যত্ প্রজন্ম শুধু দেখবে চাষাবাদের মৌমাছি।
এমনই এক সঙ্কটময় সময়ে মৌমাছির চাষাবাদে ঝুঁকে পড়ছেন আদিবাসী নারীরা। দিনবদলের প্রচেষ্টায় এটি যেন নতুন হাতিয়ার। তাদের এ প্রচেষ্টাকে সফল করতে সহযোগিতা করছেন কারিতাসের প্রমোশনাল অব লাইভলি হোড অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স (পিএলএইচআর) প্রকল্প। আদিবাসীদের জীবনমান আর মানবসম্পদের উন্নয়নের লক্ষ্যে শুরু হয়েছে সমন্বিত ফসলের চাষাবাদ। এর মধ্যে অল্প পুঁজি আর কম পরিশ্রমে বেশি আয় হচ্ছে মৌমাছির চাষাবাদে। এ মৌমাছির চাষাবাদ যেন ফিরিয়ে আনছে গারো পাহাড়ে মৌমাছির বসবাসের আগের সেই ঐতিহ্য। ধর্মীয় উৎসবসহ যে কোনো উৎসব আর অতিথি আপ্যায়নে চা–বিস্কুটের আগে পরিবেশনে স্থান পাচ্ছে মধু। এ ছাড়া দুর্বলতাসহ নানা রোগেও ওষুধ হিসেবে অনেকে সেবন করছেন মধু। উৎপাদিত মধু বিক্রি করে নিজেদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে যেন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন তারা। এরই মধ্যে শুধু মৌমাছির চাষাবাদ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন আদিবাসী নারী আইরস দালবত্সহ অনেকে। সম্প্রতি গারো পাহাড়ের মৌয়ালি, আদিবাসীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর লোকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
শেরপুর জেলার শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্তে গারো পাহাড়। এখানে প্রায় অর্ধশত গ্রাম রয়েছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যঘেঁষা এ পাহাড়ে আদিকাল থেকে আদিবাসীদের বসবাস। গভীর অরণ্যের এ গ্রামগুলোতে আগে মৌচাক ছিল আনাচেকানাচে। মাঘফাল্গুন থেকে শুরু হতো মধু আহরণ, চলত আষাঢ়শ্রাবণ পর্যন্ত। বন্য প্রাণীর হামলা উপেক্ষা করে মধু আহরণ করতেন মৌয়ালিরা। যিনি বেশি বড় বৃক্ষে বা ঝোপজঙ্গলের গাছে উঠে মধু আহরণ করতে পারতেন, তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ত চারদিকে। গারো পাহাড়ের মাইনদ্দিন, বিল্লাল মিয়া, কছিম উদ্দিন, সাইদুর ও সনু সাংমাসহ অনেক মৌয়ালি জানান, এ সীমান্তে গারো পাহাড়ের দৈর্ঘ্য প্রায় ২২ কিলোমিটার। এর মধ্যে মৌয়ালি ছিলেন ১০–১২ জন। তারা একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত চষে বেড়াতেন। যে বাড়িতে মৌচাক ছিল, সে বাড়ির মালিকরাই বেশি মধু পেয়েছেন। এখন আর পাহাড়ে মৌচাক নেই। তবে আগের সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে চলছে নীরব প্রচেষ্টা। গারো পাহাড়ের আদিবাসী নারীরা ফলমূল আর পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ রোপণ করছেন। এর পাশাপাশি শুরু করছেন মৌমাছির চাষাবাদ। এরই মধ্যে আইরস দালবত্সহ অনেক আদিবাসী নারী মৌমাছির চাষ করে দেখছেন সোনালি স্বপ্ন। শ্রীবরদীর গারো পাহাড়ের আদিবাসী গ্রাম বাবেলাকোনা। এখানে মৌমাছির চাষ করে সংসারে সচ্ছলতা আনছেন সার্টিন মারাকের স্ত্রী আইরস দালবত্। তার সাফল্যের সংবাদ এখন গারো পাহাড়ের টক অব দ্য ভিলেজ। তিনি জানান, তার সাফল্যের নেপথ্যের নানা কথা। তার এক ছেলে তিন মেয়ে। তার পরিবারে সদস্যসংখ্যা ছয়। ক’বছর আগে চরম দুর্দিনে ঢাকা ছিল পরিবারটি। সেই দুর্দিনের ভয়াবহ চিত্র মনে হলে এখনও চোখে জল আসে তার। তিনি জানান, তাদের আট–নয় একর জমি ছিল। তারা পাহাড়ি এ জমিতে জুম চাষ করত। একই জমিতে ধান আর শাকসবজিসহ সমন্বিত ফসলের চাষে উৎপাদিত ফসলে চলত সারা বছর। কিন্তু বন বিভাগ পাহাড়ের ঝোপজঙ্গল পরিষ্কার করে গড়ে তোলেন একাশি ও আকাশমণিসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের নানা বৃক্ষ। অন্যদিকে ভারতের সীমান্ত থেকে আসতে থাকে বন্য হাতি। প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর বন্য হাতির অব্যাহত হামলায় ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চরম দুর্ভিক্ষে দিন কাটান তারা।
আইরস দালবত্ বলেন, যখন দুঃসময়ে কোনো উপায় ছিল না, তখন কারিতাসের পিএলএইচআর প্রকল্প থেকে ২৫ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছি। তাছাড়া তারা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এমনকি তাদের সার্বিক সহযোগিতায় শুরু করি সমন্বিত ফসলের চাষাবাদ। পুকুরে মাছ চাষ, হাঁসমুরগির খামার, মৌমাছির চাষ ও শাকসবজির চাষাবাদ করে আসছি। এর মধ্যে মৌমাছির চাষে বেশি লাভ হচ্ছে। তার স্বামী সার্টিন মারাক জানান, ২০১২ সালের মে মাসে তাদের এ প্রকল্প শুরু হয়। শুরুতে মৌমাছির বাক্স ছিল একটি। এখন তার খামারে পাঁচটি মৌমাছির বাক্স রয়েছে, যার মূল্য প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। তাদের এ থেকে দুই মাস পরপর আয় হচ্ছে চার–পাঁচ হাজার টাকা। তিনি বলেন, মৌমাছি চাষাবাদে তেমন পরিশ্রম নেই। অন্যান্য কাজের ফাঁকেও এটি করা যায়। তবে আয় বেশি বলে মৌচাষের পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, আশপাশে ফুল আর ফলের গাছ বাড়ছে। এতে মধুর উৎপাদন বাড়বে। আইরস দালবতের মৌচাষের সাফল্য দেখে রিনি ম্রং, আঞ্জেলা মৃসহ এলাকার অনেকে মৌচাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। কারিতাসের আইসিডিপির পিএলএইচআর প্রকল্পের পরিধি বাড়ানো হলে গারো পাহাড় হবে দেশের অন্যতম মৌচাষ এলাকা। এখানকার আদিবাসী নারীসহ শত শত মানুষ মৌচাষ করে খুঁজে পাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও রফতানি করতে পারবে এখানকার মধু। এমনটাই প্রত্যাশা করছেন স্থানীয়রা। কারিতাসের আইসিডিপির প্রজেক্ট সুপারভাইজার হিলারি ম্রং বলেন, সমন্বিত ফসলের চাষাবাদের মধ্যে মৌচাষে তারা বেশি লাভ পাচ্ছেন। তাই অনেকে মৌচাষে আগ্রহী।