19.8 C
New York
Friday, September 22, 2023
spot_img

শেকৃবিতে ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধী উদ্ভিদ

ক্যান্সার ও ডায়াবেটিসের মতো রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। কেমো থেরাপির মতো ব্যয়বহুল ও যন্ত্রণাময় চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে ক্রমেই বাড়ছে প্রাকৃতিক খাদ্য ও উদ্ভিদের ভেষজ গুণের গ্রহণযোগ্যতা। এ বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছেন গবেষকরাও। তেমনই কিছু ভেষজ গুণসমৃদ্ধ উদ্ভিদ রয়েছে ঢাকার শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিভিন্ন দেশ থেকে এই উদ্ভিদ সংগ্রহ করে তার গুণাগুণ নিয়ে গবেষণা করছেন এখানকার গবেষকরা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে ইতোমধ্যেই জানা গেছে শেকৃবিতে থাকা রুকোলা (Rucola) এমনই একটি উদ্ভিদ, যা ডায়াবেটিস এমনকি ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

গবেষকরা বলছেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে নিয়মিত প্রচুর পরিমাণে সবুজ রুকোলা গ্রহণের মাধ্যমে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগ ও রক্তনালী সংক্রান্ত রোগের বিরুদ্ধে আমাদের দেহে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

রুকোলার গুণাগুণ

এর সবুজ পাতায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সহায়ক রাসায়নিক উপাদান, যেমন-সালফিউরাফ্যান, থায়োসায়ানেটস, আইসো-থায়োসায়ানেটস, ইনডলস ও আলফা-লিপোইক অ্যাসিড। এরা সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার যেমন-প্রোস্টেট, ব্রেস্ট, সারভিক্যাল, কোলন ও ওভারিয়ান ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করে। ‘হিস্টোন ডিঅ্যাসিটাইলেজ’ নামক এনজাইমের কার্যকারিতা ব্যাহত করার মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধিতে বাধা দেয় এই সালফিউরাফ্যান।

অস্ট্রেলিয়ান ‘রুরাল ইন্ডাস্ট্রিজ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলাপমেন্ট কর্পোরেশন (আরআইআরডিসি)’ এর মতে, সবুজ রুকোলা পাতার ক্যান্সার প্রতিরোধ ক্ষমতা সরিষা পরিবারের অন্যান্য শাক-সবজি থেকে অনেক বেশি। রুকোলার সবুজ পাতা যেহেতু সরাসরি পিজা এবং সালাদে ব্যাবহৃত হয়, সেহেতু সবুজ পাতায় থাকা ক্লোরোফিল, হেটারোসাইক্লিক অ্যামাইনস (যা সাধারণত উচ্চ তাপমাত্রায় তেলে ভাজলে বা ঝলসালে নিঃসৃত হয়) এর কার্সেনোজেনিক প্রভাব থেকে রক্ষা করে।

আমেরিকার ‘ন্যাশনাল নিউট্রিয়েন্ট ডেটাবেস (স্ট্যান্ডার্ডরেফারেন্স)’ অনুযায়ী, প্রতি ১০০ গ্রাম সবুজ রুকোলা পাতাতে শক্তি রয়েছে মাত্র ২৫ কিলো ক্যালরি; কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে ফলিক অ্যাসিড (৯৭ মাইক্রোগ্রাম), ভিটামিন-এ (২৩৭৩ আইইউ), ভিটামিন-সি (১৫ মিলিগ্রাম), ভিটামিন-কে (১০৮.৬ মাইক্রোগ্রাম) এবং ভিটামিন-বি-কমপ্লেক্স।

গ্রহণযোগ্য মাত্রায় রয়েছে ফ্লাভোনল নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ত্বক, ফুসফুস এবং মুখ-গহ্বরের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করে। রুকোলা পাতাতে প্রচুর পরিমাণে কপার ও আয়রন জাতীয় খনিজ উপাদানও রয়েছে। রয়েছে স্বল্প পরিমাণে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও ফসফরাস।

রুকোলাতে বিদ্যমান আলফা-লিপোইকঅ্যাসিড রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও নিয়মিত রুকোলা পাতা গ্রহণ করলে হৃদপিণ্ড এবং রক্ত নালীর রোগের ঝুঁকি কমে।

উৎপাদন ও ব্যবহার

রুকোলা একটি শীত পছন্দকারী উদ্ভিদ। শীতকালে দ্রুত পাতার বৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু বসন্তকালে গরম আবহাওয়ায় ঊর্ধ্বমুখী ফুলের স্টক তৈরি করে এবং বীজ ধারণ করে। এ উদ্ভিদটি প্রায় ২০-১০০ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।

বীজ বপনের একমাস পরেই পাতা সংগ্রহ করা যায়। রুকোলার পাতা রসালো, লম্বাটে ও খাঁজযুক্ত। শিকড় ছাড়া এ উদ্ভিদের সব অংশই, যেমন-পাতা, ফুল, অপরিপক্ক পড ও বীজখাবার উপযোগী।

তবে পাতাই খাদ্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। রুকোলার সবুজ সতেজ পাতা সরাসরি কাঁচা সালাদ হিসেবে টমেটো, জলপাই ও পনিরের সাথে, পিজা তৈরির পর পরিবেশনের সময় পিজা টপিং হিসেবে, পাস্তার সাথে এবং মাছ ও মাংস দিয়ে তৈরি বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। এ ছাড়াও এর বীজ থেকে ভোজ্য তেল উৎপাদন করা যায়। কখনো কখনো এটা শাক হিসাবে পালং শাকের মতোই রান্না করা হয়।

বংশপরিচয়

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন- ইতালিতে ‘রুকোলা’, আমেরিকাতে ‘আ রুগুলা’, জার্মানিতে ‘সালাট্রুকা’, স্পেনে ‘ইরুকা’ এবং ফ্রান্সে ‘রকেট’। রুকোলার উৎপত্তি স্থান হচ্ছে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। ইতালিতে রুকোলা রোমান কাল থেকে চাষ করা হচ্ছে, তাই ধারণা করা হয় যে ইতালিই এর উৎপত্তি স্থান। এ অঞ্চল থেকে পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশ ও মহাদেশে এটি বিস্তার লাভ করে।

বর্তমানে এটি বাণিজ্যিকভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ (ইতালি, ফ্রান্স,পর্তুগাল ও চেকপ্রজাতন্ত্র), মিশর, তুরস্ক ও আমেরিকাতে (ইন্ডিয়ানা এবং মিডওয়েস্ট) চাষ হচ্ছে।

রুকোলা হচ্ছে সরিষা পরিবারের (Brassicaceae) একাটি বর্ষজীবি, দুর্বলকাণ্ড ও সবুজ পাতাবিশিষ্ট উদ্ভিদ, যার বৈজ্ঞানিক নাম Eruca sativa এই প্রজাতির দেহগত ক্রোমোসোম সংখ্যা ২n = ২২ এবং বীজই হচ্ছে বংশ বিস্তারের একমাত্র মাধ্যম।

বাংলাদেশে রুকোলা চাষের সম্ভাবনা

আমাদের দেশে এ পর্যন্ত কোথাও রুকোলা চাষের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে ২০১৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম ইতালি থেকে বীজ সংগ্রহ করে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগে এই উপকারী উদ্ভিদটি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে।

গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, এটি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সারা বছর জন্মানোর উপযোগী। তবে পাতার বৃদ্ধি ও উৎপাদন শীতকালে সবচেয়ে বেশি হয়। কিন্তু পাতার মতো সারা বছর বীজ উৎপাদন করা যায় না, শুধুমাত্র শীতের শেষে-বসন্তের শুরুতে এ উদ্ভিদটি ফুল ও বীজ উৎপাদন করে। বাংলাদেশে রুকোলা চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

যেহেতু সারা বছর রুকোলার পাতা উৎপাদন সম্ভব, তাই গ্রামে বাড়ির আঙিনায় সামান্য একটু জায়গায় এবং শহরে ৪-৫টি টবে বাসার ছাদে কিংবা ঝুল-বারান্দায় জন্মিয়ে সারা বছর সতেজ পাতা পাওয়া সম্ভব।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

Related Articles

Stay Connected

0FansLike
3,867FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles