একক পদ্ধতিতে পাঙ্গাশ চাষ পদ্ধতি
আমরা আজকে আলোচনা করবো অধিক উৎপাদন বৃদ্ধিতে একক পদ্ধতিতে পাঙ্গাশ চাষ পদ্ধতি নিয়ে, কারন পাঙ্গাশ চাষ সাধারণত সবাই মিশ্র ভাবেই মাছ চাষ করে থাকে। আর্টিকেল টি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন এবং বন্ধুদের কাছে শেয়ার করে দিন।
চাষের ভুমিকাঃ
এক সময় বাংলাদেশের নদ-নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাঙ্গাশ মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণে বর্তমানে এ মাছের মজুদ প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। দেশীয় প্রজাতির এই পাঙ্গাশ মাছ খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু, তাই চাহিদাও ব্যাপক। কিন্তু প্রাকৃতিক উৎসের দেশি পাঙ্গাশ মাছ পুকুরে চাষের প্রসার ঘটেনি। তবে ১৯৯০ সালে থাইল্যান্ড থেকে থাই পাঙ্গাশের পোনা এনে পুকুরে চাষ করা হয়, যা এদেশে মৎস্য সম্পদের নতুন সংযোজন। এদেশে ক্ষুদ্রায়তন পুকুরের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বৃহদায়তন জলাশয়ে থাই পাঙ্গাশ চাষের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালে বিদেশি প্রজাতির এ মাছের কৃত্রিম প্রজনন সম্ভব হয়েছে।
লক্ষণীয় যে, থাই পাঙ্গাশ বর্তমানে দেশের বর্ধিত জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। প্রাণীজ আমিষের শতকরা ৬৩ ভাগ আসে মাছ থেকে, যার অধিকাংশই পূরণ হয় পাঙ্গাশ দ্বারা। বর্তমানে বাচ্চাদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছ হচ্ছে পাঙ্গাশ। কেননা, এ মাছ কাঁটাবিহীন ও সুস্বাদু। অত্যন্ত আশার কথা, বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পানির পরিবেশ থাই পাঙ্গাশ চাষের জন্য যথার্থই অনুকূল।
পাঙ্গাশ চাষের সুবিধা কি:
১. পাঙ্গাশ মাছ সর্বভুক হওয়ায় তৈরি খাদ্য দিয়ে চাষ করা সম্ভব।
২. এ মাছ দ্রুত বর্ধনশীল, উচ্চফলনশীল ও বিদেশে রফতানিযোগ্য।
৩. যে কোনো ধরনের জলাশয় অর্থাৎ পুকুর-দিঘিতে চাষ করা যায়।
৪. অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্র থাকায় প্রতিকূল পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে।
৫. মিঠা ও স্বল্প নোনা পানিতে চাষ করা যেতে পারে।
৬. জীবিত অবস্থায় বাজারজাত করা সম্ভব।
৭. সুস্বাদু, প্রচুর চাহিদা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি।
৮. হ্যাচারিতে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সহজেই থাই পাঙ্গাশের পোনা উৎপাদন করা যায়।
সঠিক পুকুর নির্বাচন:
পুকুরের আয়তন ৬০ থেকে ১০০ শতাংশ এবং গভীরতা ৫ থেকে ৭ ফুট হওয়া বাঞ্চনীয়। দোআঁশ ও পলিযুক্ত এটেল মাটি পাঙ্গাশ চাষের জন্য সর্বোত্তম। পুকুরে পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা অত্যাবশ্যক।
পুকুর প্রস্তুতকরণ করবেন কীভাবে:
পুকুর পাড়ের ঝোঁপঝাড় পরিষ্কার রাখতে হবে। পুকুরে জলজ আগাছা, রাক্ষুসে মাছ ও অবাঞ্ছিত প্রাণী রাখা যাবে না। পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে রাক্ষুসে মাছ ও অনাকাঙ্খিত পানি দূর করার পর প্রতি শতাংশে এক কেজি হারে এবং পুকুরের মাটি লাল অমস্নীয় হলে ২ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করা অতীব জরুরি। শুকনো পুকুরে চুন দেয়ার পর প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করতে হবে। পুকুর প্রস্তুতির সময় প্রতি শতাংশে ৮ থেকে ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ১৫০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করা অত্যাবশ্যক। সার প্রয়োগের ৫ থেকে ৬ দিন পর পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য (প্লাংটন) তৈরি হলে পুকুরে মাছের পোনা ছাড়তে হবে।
পাঙ্গাস মাছের জাত কয়টি ও কি কি?
আমরা বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরণের পাঙ্গাস মাছের জাত পাই। পাঙ্গাসিয়াস পরিবারভুক্ত এসব মাছের মধ্যে রয়েছেঃ
১. থাই পাঙ্গাস বা রোহু পাঙ্গাস,
২. জাভা পাঙ্গাস,
৩. সুত্রী পাঙ্গাস,
৪.পাঙ্গাস মাইক্রোনেমাস,
৫. পাঙ্গাস নাসুটাস,
৬.পাঙ্গাস পলিউরানোডন,
৭.পাঙ্গাস প্লুরানিয়েটাস
৮. পাঙ্গাস বোকোরি। এছাড়াও কিছু অন্যান্য প্রজাতির পাঙ্গাস যেমন পাঙ্গাস কিউপারি, পাঙ্গাস প্লাটোইস্ট্রাস, পাঙ্গাস কিনিয়ারেঙ্গা ইত্যাদি বাংলাদেশে পাওয়া যায়। তবে এদের বাণিজ্যিক চাষ এখনও বেশি হয়নি।
সবচেয়ে বেশি চাষ হয় থাই বা রোহু পাঙ্গাসের। কারণ এই প্রজাতি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও লাভজনক। এছাড়া জাভা ও সুত্রী পাঙ্গাসের বাণিজ্যিক চাষও করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের পরিবেশগত অবস্থা পাঙ্গাস চাষের জন্য খুবই উপযোগী বলে বিবেচিত হয়।
পোনা মজুদকরণ পদ্ধতি:
অধিক উৎপাদন পেতে হলে একক পদ্ধতিতে পাঙ্গাশ চাষ করা উত্তম। একক চাষের ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে ৫ থেকে ৭ ইঞ্চি আকারের পাঙ্গাশের পোনা ১২৫ থেকে ১৫০টি এবং মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে ৫০ থেকে ৬০টি পাঙ্গাশের পোনা ৫ থেকে ১০টি কাতলের পোনা, ২৫ থেকে ৩০টি বিগহেড বা সিলভার কার্পের পোনা এবং ২০ থেকে ২৫টি রুইয়ের পোনা ছাড়া যেতে পারে। তৈরি খাবার সরবরাহ: পাঙ্গাশ মাছের একক চাষের ক্ষেত্রে তৈরি খাদ্য সরবরাহ করা একান্তই অপরিহার্য।
এ মাছ চাষে আমিষযুক্ত সুষম খাদ্য অত্যাবশ্যক। খাবার দানাদার হওয়া বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে ফিশমিল ২০ শতাংশ, সরিষার খৈল ৪৫ শতাংশ এবং গমের ভুসি ৩৫ শতাংশ একত্র করে সামান্য পানি মিশিয়ে দানাদার খাদ্য তৈরি করে রোদে শুকাতে হবে। মাছের খাবার চাষকৃত মাছের দেহের ওজনের শতকরা ৮ থেকে ৩ ভাগ হারে সরবরাহ করা অত্যাবশ্যক। পর্যায়ক্রমে খাদ্যের পরিমাণ হ্রাস করতে হবে। এছাড়া শামুক, ঝিনুক, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুর নাড়িভুঁড়ি টুকরো করে কেটে পাঙ্গাশ মাছকে লোভনীয় খাবার হিসেবে দেয়া যেতে পারে। পোনা মজুদের পর দিন থেকে নিয়মিত সকাল ও বিকাল দু’বার খাবার সরবরাহ করা জরুরি। শীতকালে মাছের খাবার কমাতে হবে।
মাছে রোগবালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি:
পানির গুণাগুণ নষ্ট হলে মাছে ঘা দেখা দিতে পারে। পানির গুণাগুণ মাছ চাষের অনুকূলে আনার জন্য চুন, লবণ বা জিওলইট প্রয়োগ করতে হবে। মাছে ক্ষত রোগ দেখা দিলে মাছের খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। প্রয়োজনে দূষিত পানি বের করে পরিষ্কার, ঠান্ডা ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। রোগবালাই থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনে নিয়মিত পানি পরিবর্তন করতে হবে।
পরামর্শ:
১. পোনা মজুদের আগে পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা করতে হবে,
২. নার্সারি পুকুরে রেণু বা ধানি পোনা ছাড়ার আগে ক্ষতিকর হাঁসপোকা বা ব্যাঙাচি ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে।
৩. মজুদকৃত মাছকে নিয়মিত সুষম খাবার সরবরাহ করতে হবে।
৪. সুস্থ-সবল পোনা মজুদ করতে হবে।
৫. পোনা ছাড়ার উপযোগী সময় সকাল-বিকালের মৃদু ঠান্ডা আবহাওয়া। দুপুরের রোদ, মেঘলা ও নিম্নচাপের দিনে পোনা ছাড়া সমীচীন নয়।
মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ পদ্ধতি:
সঠিক চাষ ব্যবস্থাপনা, উন্নতমানের পোনা মজুদ ও যথানিয়মে সুষম খাবার প্রয়োগ করা সম্ভব হলে মাত্র ৬-৭ মাসে পাঙ্গাশ মাছের গড় ওজন ৯০০ থেকে ১০০০ গ্রাম হয়ে থাকে। বারবার আহরণ করে মাছ বাজারজাত করা হলে মাছের উৎপাদন সন্তোষজনক হয়। এক্ষেত্রে মাত্র ৬ মাসে একটি ভালো ফলন আশা করা যায়। অর্থাৎ একই পুকুরে বছরে দু’বার পাঙ্গাশ মাছের ফলন পাওয়া সম্ভব।
আর্টিকেল টি পড়ে ভালো লাগলে অন্য কৃষি উদ্যোক্তা বন্ধুদের কাছে শেয়ার করে দিন নিজের টাইমলাইনে শেয়ার করে বেশিদিন সংরক্ষণ করে রাখুন।