গবাদিপশু হাঁস মুরগির খাবারে জীবনঘাতী অ্যান্টিবায়োটিক

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

মানুষের জন্য তৈরি অ্যান্টিবায়োটিকের অতিমাত্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে হাঁস-মুরগি, মাছ ও গরু-ছাগলের খাবার উৎপাদনে। এতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধক জীবাণু জন্মায় প্রাণীর শরীরে। এই অ্যান্টিবায়োটিক মাংসের মাধ্যমে আবার ঢুকছে মানুষের শরীরে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য জীবন ঘাতক হিসেবে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের (এনসিআরপি) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাছ-মাংস বা অন্য খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করা অ্যান্টিবায়োটিকের বিপজ্জনক প্রভাব পড়ছে কিডনি ও লিভারের ওপর। আবার অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতাও বড় বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক রোগজীবাণু মেরে ফেলে। তবে কোনো কারণে শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসট্যান্স বা প্রতিরোধী জীবাণু তৈরি হলে তা হবে নীরব ঘাতক। অ্যান্টিবায়োটিক যুক্ত খাবার গ্রহণকারী প্রাণীর মাংস খেলে এমন অবস্থা তৈরি হতে পারে। তখন ছোটখাটো রোগ নিরাময়েও অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজ দেবে না। তিনি বলেন, বিশ্বের কোথাও প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বেচা বা কেনা সম্ভব নয়, শুধু বাংলাদেশেই এটা সম্ভব হচ্ছে। যে কেউ যখন-তখন ওষুধের দোকানে গিয়ে যে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কিনতে পারছেন প্রেসক্রিপশন ছাড়াই। আর এ কারণেই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি জরিপের তথ্য উল্লেখ করে এনসিআরপির প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর সারা বিশ্বে ৬৩,২০০ টন অ্যান্টিবায়োটিক প্রাণিদেহে ব্যবহৃত হয়েছে। এভাবে চললে ২০৩০ সালে এটি ১ লাখ ৫,৬০০ টনে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ২০ লাখ লোক অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসট্যান্স (প্রতিরোধী) সমস্যায় আক্রান্ত হয়। তাদের মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার লোক মারা যান। এতে আরও বলা হয়, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসট্যান্সের সংকটটি এখনই থামানো না গেলে মানবসভ্যতা অদূর ভবিষ্যতে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। কোনো জটিল সংক্রমণ নয়, বরং অতি সাধারণ সংক্রমণেই মানুষ মারা যেতে পারে। কারণ কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই তখন কার্যকর থাকবে না। তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানে পশু, হাঁস-মুরগি ও মাছ চাষের সময় রোগ প্রতিরোধমূলক ও মোটাতাজাকরণ কাজে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। রোগাক্রান্ত প্রাণীর চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হলে তা যেন প্রাণীর জন্যই তৈরি অ্যান্টিবায়োটিক হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

আরও পড়ুন   ব্রোকোলির পাতার রিং দাগ রোগ

এদিকে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও এর কার্যকারিতা নিয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) উদ্যোগে একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ঢাকার ওপর পরিচালিত ওই সমীক্ষায় বলা হয়, ৫৫.৭০ শতাংশ মানুষের দেহে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর। এর অর্থ হচ্ছে ঢাকা মহানগরে যেসব রোগজীবাণুর সংক্রমণ ঘটে তার বিরুদ্ধে ৫৫.৭০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজ করে না। পবার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে মৎস্য খামারে ১০ ধরনের ও ৫০ শ্রেণির রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব রাসায়নিকের মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক ও গ্রোথ এজেন্ট। প্রাণিসম্পদ খাতে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের কিডনি, লিভার ও হৃৎপিণ্ডের ক্ষতি করছে। এ ছাড়া বিশ্বে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের ৫০ শতাংশ কৃষি খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে কৃষি খাতে ৬৩ হাজার ২০০ টন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হচ্ছে। এমন অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিসট্যান্সের ফলে বিশ্বে ২০৫০ সাল নাগাদ বছরে প্রায় ১ কোটি মানুষ মারা যাবেন বলে ধারণা করা হয়। এনসিআরপির প্রতিবেদনে বলা হয়, খাবারের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের অনুপ্রবেশ ঘটছে তিনভাবে। প্রথমত, মাংস, দুধ ও মাছের খামারিরা তাদের অসুস্থ পশু ও মাছের চিকিৎসা করার জন্য। দ্বিতীয়ত, ফিড ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্টিবায়োটিক মেশাচ্ছে। আর তৃতীয়ত, পরিবেশ দূষণের কারণে খাবারের পানিতে অতিসামান্য অ্যান্টিবায়োটিক মিশে যাচ্ছে। কিন্তু প্রাণিচিকিৎসক মানুষের চিকিৎসায় নির্দেশিত অ্যান্টিবায়োটিকের অনেকগুলোই অতি মুনাফার লোভে নিয়ম-বিরুদ্ধভাবে প্রাণিচিকিৎসায় ব্যবহার করছেন। এসব অ্যান্টিবায়োটিক রোগ সারার বহু পরও প্রাণীর শরীরে থেকে যায়। ফলে এসব পশুর মাংস বা দুধ কিংবা মাছ খেলে মানব শরীরে প্রবেশ করে প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। ফলে কোনো মানুষ জীবাণু সংক্রমণে অসুস্থ হওয়ার পর সেই অ্যান্টিবায়োটিক খেলেও কোনো কাজ হয় না। এটি এখন বৈশ্বিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। বিজ্ঞানীরা এ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘ চাইছে পশু, হাঁস-মুরগি ও মাছ চাষের সময়ে ‘রোগ প্রতিরোধমূলক’ ও ‘মোটাতাজার’ কাজে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হোক বলে গবেষণায় আহ্বান জানানো হয়।

আরও পড়ুন   ডেইরি ফার্ম

কনজিউমার্স ইন্টারন্যাশনাল এক হিসেবে জানিয়েছে, জীবাণুর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের কারণে এখন যে হারে মানুষ মারা যাচ্ছেন, তা কমানো না গেলে ২০৫০ সালে এশিয়া মহাদেশে ৪৭ লাখ ৩০ হাজার, আফ্রিকাতে ৪১ লাখ ৫০ হাজার, দক্ষিণ আমেরিকাতে ৩ লাখ ৯২ হাজার, ইউরোপে ৩ লাখ ৯০ হাজার, উত্তর আমেরিকাতে ৩ লাখ ১৭ হাজার এবং ওসেনিয়াতে ২২ হাজার মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। তাদের মধ্যে আবার বেশির ভাগই শিশু, গর্ভবতী মহিলা ও বৃদ্ধ।

অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের মতে, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের স্বার্থে সরকার যেন এ বিষয়ে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং আইন ভঙ্গকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে। তিনি বলেন, গাজীপুর জেলার এক খামারি জানিয়েছিলেন, আগে তারা এক হাজার মুরগির জন্য ১৫-১৮ হাজার টাকার ওষুধ কিনতেন। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকমুক্ত মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর এখন লাগে মাত্র ৪-৫ হাজার টাকা, উৎপাদনও হয় বেশি।

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now