পাঙ্গাস মাছ চাষ পদ্ধতি
আজকে আমরা আলোচনা করবো ডিজিটাল পন্থায় পাঙ্গাস মাছ চাষ পদ্ধতি নিয়ে যাতে কৃষি উদ্যোক্তারা মাছ চাষে সফল হয়। সবাই পড়ে শেয়ার করে দিবেন অন্য সব উদ্যোক্তাদের মাঝে।
মাছ চাষ বাংলাদেশে সম্প্রতি দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে , একসাথে পৃথিবীতে মাছ উৎপাদনের একটি সম্মানসূচক অবস্থান নিয়েছে। আজকে আমরা আলোচনা করবো পাঙ্গাস মাছের চাষ উপায় নিয়ে।
আবহমানকাল থেকে পাঙ্গাস মাছ এদেশের মানুষের জন্য রসনার সোর্স হিসেবে পরিচিত। এ মাছটি প্রাকৃতিক মুক্ত দিঘিতে বিশেষ করে রাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের নদীসহ উপকূলীয় এলাকায় পাওয়া যায়। এক সময়ে পাঙ্গাস মাছ আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে উচ্চবিত্তের মাছ হিসেবে বিবেচনা করা ছিল। অধুনা পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে নদীর নাব্যতা দিন দিন ক্ষয় পাচ্ছে। সাথে সঙ্গে এর প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রসমূহ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ফলে পাঙ্গাস মাছের উৎপাদনও ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে। কিন্তু দিঘিতে পাঙ্গাস চাষের বিপুল সম্ভাবনা থাকায় আশির দশক থেকেই এর ওপর কার্যক্রম অব্যহত রয়েছে।
পাঙ্গাস মাছের নানারকম জাত:
পাঙ্গাস মাঝের জাতগুলোর ভিতরে দেশী পাঙ্গাস এবং থাই পাঙ্গাস সবচেয়ে বহু জনপ্রিয়। চলুন এদের পরিচয় সম্মন্ধে বর্তমান কয়েকটি ইনফরমেশন জেনে নেই,
১. দেশী পাঙ্গাস:
দেশী পাঙ্গাসের রূপালী রঙের পিঠের দিকে কালচে ও পার্শ্ব রেখার ওপরে অল্প ধূসর। এই মাছের শরীরে কোন আঁশ নেই। এখনও আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রজাতির পাঙ্গাস সুস্বাদু ও বহু মূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, বহ্মপুত্র এবং যমুনা নদীতে এই মাছটি অধিক পাওয়া যায়। এরা প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। মার্চ হতে জুন মাস পর্যন্ত রাষ্ট্রের দক্ষিণ অঞ্চলের নানারকম নদীসহ সর্বশ্রেষ্ঠ নদীগুলোতে এর পোনা পাওয়া যায়।
২. থাই পাঙ্গাস:
এদের আদিবাস থাইল্যান্ডে, কম্পুচিয়া, ভিয়েতনাম এবং পাশ্ববর্তী অঞ্চলের দেশে। আমাদের দেশে সর্বপ্রথম ১৯৯৩ সনে বিদেশী এ প্রজাতির মাছের সফল প্রজনন করানো সম্ভব হয়েছে। অধুনা বাণিজ্যিক চাষাবাদের ক্ষেত্রে থাই পাঙ্গাস একটি সনামধন্য নাম। দেশী পাঙ্গাসের চেয়ে এই গোষ্ঠী ফাস্ট বৃদ্ধি পায়। এ মাছটি সর্বোচ্চ ১০-১২ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
পাঙ্গাস মাছের চাষ পদ্ধতি:
মাছ চাষের পদ্ধতিটি নির্ভর করে জলাধার বা জলাশয়ের বৈশিষ্ট্য, পরিবেশেগত অবস্থা, জল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা, পুঁজি, মানসম্মত পোনা প্রাপ্তি, বাজার ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি বিষয়ের ওপরে। এসব বিষয়গুলোকে মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় চাষ পদ্ধতিটি কিরকম হবে। আজকে আমরা জানব পাঙ্গাস মাছের একক চাষ বা নিবিড় চাষ সম্পর্কে।
পাঙ্গাস মাছের একক বা নিবিড় চাষাবাদ কি?
এ উপায়ে কম টাইমে বহু উৎপাদনের উদ্দেশ্যে বেশি ঘনত্বে পোনা মজুদ করা হয়। এক্ষেত্রে আমিষ উন্নত মানব নির্মিত আহার প্রয়োগের দ্বারা অধিক মুনাফা করা যায়। সমৃদ্ধ চাষ ব্যবস্থাপনার দ্বারা হেক্টর প্রতি ১৫ হতে ২০ টন পাঙ্গাস উৎপাদন করা সম্ভব। একক চাষে প্রতি হেক্টরে ৮ হতে ১০ সেমি. আকারের ২০,০০০ হতে ২৫,০০০ টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে বছরের পোনা মজুদ করে অধিক উদ্ভাবন এবং বহু মুনাফা বাড়ানো সম্ভব।
পাঙ্গাস চাষের সরোবর নির্বাচন:
পাঙ্গাস চাষের সরোবর আয়তাকার হলে ভাল হয়। দিঘির তলা ভালভাবে সমতল করে নিতে হবে। দিঘির পানির গভীরতা ১.৫ থেকে ২ মিটার পর্যন্ত রাখা দরকার।
পাঙ্গাস চাষের জন্য দোআঁশ মাটির জলাভূমি সবেচেয়ে ভাল। তাৎপর্যপূর্ণ স্বার্থে যাতে দ্রুত জল দেয়া যায় সেজন্য দিঘির কাছেই অতল বা অগভীর নলকূপের আয়োজন রাখা দরকার।
বর্ষায় বা অতিরিক্ত বৃষ্টিতে যাতে করে জলাভূমি ভেঙ্গে না যায় সেজন্য আগে থেকেই দরকারী মেরামত সেরে ফেলতে হয়।
সর্বোপরি এমন জায়গায় পুকুরটি বেছে নিতে হবে যেখানে যোগাযোগের অ্যাডভান্টেজ ভাল এবং প্রচুর সিকিউরিটি অ্যারেঞ্জমেন্ট রয়েছে।
পুকুর প্রস্তুতি:
পুকর ইলেকশন করার পরের কাজটি হচ্ছে পুকুরকে ভালভাবে রেডি করে নেয়া। এই সময়ে জেনে নেয়া যাক পুকুর প্রিপারেশন সম্মন্ধে কতিপয় ইম্পোর্টেন্ট তথ্য।
পুকুরে নানা প্রকৃতির ও বৈশিষ্ট্যে জলজ আগাছা থাকলে প্রথমেই সেগুলোকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
পাঙ্গাস চাষের পুকুরে অপ্রয়োজনীয় এবং রাক্ষুসে মাছ যেমন-শোল, বোয়াল, গজার, টাকি, বাইম, মলা, ঢেলা ইত্যাদি মাছকে পাঙ্গাস চাষের আগেই অপসারণ করতে হবে। বিভিন্নভাবেই এদেরকে অপসারণ করা যায়।
এসবের মধ্যে রয়েছে-
ঘন ফাঁসের জাল বারবার টেনে সকল প্রকারের অনাকাক্সিক্ষত মাছ সরিয়ে ফেলতে হবে;
পুকুরের জল পরিষ্কার করে ও সম্ভব হলে তলার মাটি লাঙ্গল দ্বারা চাষ করে দিতে হবে;
অনেক টাইম বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করলেও অপ্রয়োজনীয় ও রাক্ষুসে মাছদের সম্পূর্ণ বিনাশ করা পসিবল হয়ে যায় না। সেক্ষেত্রে স্থানীয় মৎস্য অফিসের পরামর্শ অনুসারে বিভিন্ন রোগের প্রতিকারক ব্যবহার করে এদের দমন করা যেতে পারে।
পুকুরকে মাছ চাষের যোগ্য এবং টেকসই করতে চুন ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে সব দিঘির পানিতে অম্লত্বের সমস্য নাই সেখানে প্রতি হেক্টরের জন্য ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি চুন ব্যবহার করতে হয়। চুন প্রয়োগের আগে গুড়ো করে মিহি করে নিলে এর কার্যকারিতা অনেকগুণ বেড়ে যায়।
পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য বৃদ্ধির জন্য জৈব এবং রাসায়নিক সার দুটোই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রধারনত চুন প্রয়োগের ৪/৫ দিন পর সার প্রয়োগ করতে হয়। নতুন জলাভূমি ও বেলে মাটির দিঘিতে জৈব সার অধিক প্রয়োগ করতে হয়। তবে পুরাতন কাদাযুক্ত দিঘিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগের হার বেশি হবে। দিঘি প্রস্তুতকালীন সময়ে জৈব সার হিসেবে প্রতি শতকে ৮ হতে ১০ কেজি গোবর কিংবা ৪ হতে ৫ কেজি মুরগীর বিষ্ঠা ব্যবহার করতে হবে।
সারের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য প্রতি শতকে ১০০ গ্রাম টিএসপি জৈব সারের সঙ্গে ৮ হতে ১০ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে ইউজ করতে হয়। ব্যবহারের প্রথমে প্রতি শতকে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া মিশিয়ে মিশ্রনটি যাবতীয় দিঘিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের ৪ হতে ৫ দিন পর পুকুরের পানির রঙ সবুজ বা বাদামী হলে প্রধারনত পোনা মজুদের উপযুক্ত হয়।
পোনা সংগ্রহ ও পরিবহন:
পুকুরের প্রস্তুতি শেষ হলে পুষ্ট গুনাগুন সমাপ্ত পাঙ্গাস মাছের পোনা সংগ্রহ করতে হয়। এই জন্য বিশ্বাসী কোন হ্যাচারী থেকে পোনা সংগ্রহ করা উচিত। পোনা পরিবহনের টাইম বিশেষ সতর্কতা নিতে হবে যাতে করে পরিবহনের সময় পোনার কোন ক্ষতি না হয়। পরিবহনের আগেই চৌবাচ্চায় ৪ হতে ৫ ঘন্টা পোনাকে উপোস রেখে টেকসই করে নিতে হবে। পরিবহনের টাইম পোনাকে অধিক উত্তেজিত করা উচিৎ নয়
পাঙ্গাস মাছের খাদ্য প্রয়োগ:
পাঙ্গাস চাষে দিঘিতে যে প্রাকৃতিক আহার প্রস্তুত হয়, তা মাছের আশানুরূপ ফলনের জন্য যথেষ্ঠ নয়। একারণে সুষম খাবার ব্যবহার নিশ্চয়ই নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে চাষ পর্যায়ে দৈনিক সুনির্দিষ্ট সংখ্যা খাদ্য যোগাড় না করতে পারলে পাঙ্গাসের উদ্ভাবন বাধাগ্রস্থ হবে। মাছের খাবারের পরিমান মাছের বয়স এবং দেহের ওজনের উপর নির্ভর করে। ১৫ দিন পর পর দৃষ্টান্ত হিসেবে কয়েকটি মাছের ওজন এক্সাম করে দেখতে হবে মাছ নির্ভুল মতো বেড়েই চলেছে কিনা।
নির্দিষ্ট সংখ্যা খাদ্য দিঘির আয়তন অনুযায়ী নির্ধারিত ৬ হতে ৮ টি স্থানে প্রদান করা ভাল। দানাদার জাতীয় খাবার ছিটিং এবং সম্পূরক অন্ন বল আকারে সুনির্দিষ্ট জায়গায় যোগাড় করতে হয়। খাবার একবারে না দিয়ে ২ হতে ৩ বারে সমানভাবে অংশ করে ব্যবহার করলে খাদ্যের কার্যকারীতা পর্যাপ্ত বেড়ে যায়। এই ছাড়া প্রয়োজনমতো চুন এবং সার প্রয়োগ করাটাও জরুরি।
মাছ সংগ্রহ:
বাজারের চাহিদার উপর কেন্দ্র করে মাছ মজুদের ৫-৬ মাস পর যখন পাঙ্গাসের এ্যাভারেজ ভর ৫০০ হতে ৬০০ গ্রাম হয়, তখনই মজুদকৃত মাছের ৫০% বাজারে বিক্রি করে দিতে হয়। এতে করে অবশিষ্ট মাছ ফাস্ট বেড়ে ওঠার চান্স পায়।
শেষ কথা:
খাদ্য সিকিউরিটি নিশ্চিত করে পারিপারিক পুষ্টির ডিমান্ড পূরণে মাছের চাষ ১টি ইম্পোর্টেন্ট অবদান পালন করে আসছে। সারা দেশের প্রায় আড়াই লক্ষ হেক্টর পুকুর, দীঘি ইত্যাদিসহ প্রায় ৬ থেকে ৭ লক্ষ হেক্টর দিঘিতে পরিকল্পিতভাবে পাঙ্গাস মাছের চাষ করলে দেশের সামগ্রিক মৎস্য উদ্ভাবন কয়েকগুন বেড়ে যাবে। কর্মসংস্থানের চান্স সৃষ্টি হবে এদেশের ব্যাপক সংখ্যক বেকার যুব ও যুব মহিলাদের। প্রায় হারিয়ে যাওয়া আমাদের পরম্পরায় চলে এসেছে ’মাছে ভাতে বাঙ্গালী’-কে পুনরুদ্ধার করতে এজন্য পাঙ্গাস মাছের চাষ ১টি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে।