আজ শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩২ পূর্বাহ্ন

আলুর রোগবালাই ও তাঁর প্রতিকার

আলুর রোগবালাই ও তাঁর প্রতিকার
আলু বাংলাদেশের একটি অর্থকারী ফসল। আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে আলু চাষ করা হয়। বর্তমানে আমাদের দেশের চাষীরা আলু চাষ করে ব্যপকহারে লাভবান হচ্ছে। কিন্তু এই আলু চাষ করার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে আলু বিভিন্ন ধরণের রোগে আক্রান্ত হয়। যদি আলু গাছ বা আলুকে এই সমস্ত রোগবালাই থেকে দূরে না রাখা যায় তাহলে আলুর কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যাবে না। আসুন জেনে নেই আলুর কিছু রোগ ও এর প্রতিকার। 
 
রোগের প্রভাব ও লক্ষণ/বর্ণনা
 
১। আরলি ব্লাইট (Early blight):  আরলি ব্লাইট রোগ Alternaria solari নামক ছত্রাকের আক্রমনে হয়।  রোগের লক্ষণ পাতায় দেখা দেয়। প্রথমে ডগার উপরের দিকের অনুফলকে এবং পরে নিচের অনুফলকে দাগ হয়। দাগ প্রথমে বাদামী মনে হয় এবং পরে উহা কালো হয়ে যায়। ধীরে ধীরে দাগ অসমানভাবে চাকার মত বাড়তে থাকে এবং উহার মহদ্যে অনেকগুলি ছোট ছোট গায় রঙের গোল দাগ পড়ে। আক্রান্ত স্থান শুকিয়ে যায় কিন্তু পচে না ও সহজে ভাঙে না। রোগের শেষ অবস্থায় সমস্ত পাতা মুড়াইয়া আসে এবং শুকিয়ে যায়। এই ধরণের দাগ কাণ্ড ও পাতার বোঁটায় হতে পারে। পাতা কাণ্ড হতে এ রোগ আলুতে ছড়াতে পারে। সাধারণত আলুতে আক্রান্ত অংশের খোসার রং সুস্থ অংশ অপেক্ষা একটু গাঢ় হয়। এই দাগ কিছুটা ডোরা, গোলাকার অথবা আঁকাবাঁকা হয়। সুস্থ ও আক্রান্ত স্থানের সীমারেখা বেশ স্পষ্ট এবং অনেক সময় কিছুটা উঁচু হয়ে থাকে। আক্রান্ত স্থানের নীচের তন্তু বাদামী মনে হয়। রোগের জন্য গাছে আলুর সাইজ ছোট হয়ে যায় এবং ফলন অনেক কমে যায়।
২। লেইট ব্লাইট (Late blight) রোগঃ লেইট ব্লাইট রোগ অনেকে মড়ক রোগ বলে থাকেন। কারণ এই রোগের জন্য অনেক সময় মাঠের সমস্ত ফসলই নষ্ট  হয়ে যায়। এমনকি আল্প আক্রনাত গাছের আলু গুদামজাত করার পরও পচে নষ্ট হয়। phytophthora ingestans নামক এক ধরণের ছত্রাকের আক্রমণ হয়ে থাকে। 
রোগের প্রাথমিক অবস্থায় পাতার অগ্রভাগ ও কিনারায় ছোট ছোট আঁকাবাঁকা পানি ভেজা দাগ দেখা দেয়। ক্রমে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দাগগুলি প্রথমে বাদামি এবং পরে কালো রং ধারণ করে। অনুকূল আবহাওয়ায় দাগগুলি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং সমস্ত পাতায় ছড়িয়ে পড়ে আর্দ্র ও স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় রোগ মাটির নীচে আলুতে  ছড়িয়ে পড়ে। 
 
রোগ বিস্তারের অনুকূল আবহাওয়াঃ আর্দ্র (৯১-১০০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা) ও ঠাণ্ডা (১০-২০ সেঃ) রাত্রিতে ছত্রাক খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং স্পোর উৎপন্ন করে। রোগ সংক্রমনের পর রোগ বৃদ্ধির জন্য ২১-২৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। আলুর মৌসুমে নিম্নলিখিত ৪ টি অবস্থার সমন্বয় ঘটে তাহলে রোগ মহামারী রূপে দেখা দেয়।
ক) রাত্রিতে কমপক্ষে ৪ ঘণ্টা ডিউপয়েন্টের (Dew point) নীচে তাপমাত্রা থাকতে হবে।
খ) রাত্রিতে ১০ ডিগ্রী সেঃ উহার কিছু বেশী তাপমারা থাকতে হবে।
গ) পরবর্তী দিনে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকতে হবে।
ঘ) ইহার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৩.১ মি.মি. বৃষ্টিপাত হতে হবে।
উপরোক্ত অবস্থার উপর নির্ভর করে অনেক স্থানে রোগ নিয়ন্ত্রনের কাজ ত্বরান্বিত করতে হয়।   
৩। আলুর পাতা মোড়ানো রোগঃ ইহা একটি ভাইরাসজনিত রোগ। আক্রান্ত গাছের পাতা খসখসে, খাড়া ও উপরের দিকে মুড়ে যায়৷ আগার পাতার রং হালকা সবুজ হয়ে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়৷ কখনো আক্রান্ত পাতার কিনারা লালচে বেগুনি রংয়ের হয়৷ গাছ খাটো হয় এবং সোজা হয়ে উপরের দিকে দাঁড়িয়ে থাকে৷ আলুর সংখ্যা কমে যায় এবং আলু অনেক ছোট হয়।
৪। মৃদু মোজাইকঃ  পটেটো ভাইরাস এ এবং এক্স এর কারণে এ রোগ দেখা যায়। পাতা হলদে হয় ও তার উপরে বিভিন্ন বর্ণের দাগ পড়ে। পাতা কিছুটা কুঁকড়িয়ে গাছ খর্বাকৃতির হয়।
৫। কমন স্কেব (Common scab)-  শুধু মাত্র টিউবারেই লক্ষণ প্রকাশ পায়। Streptomyces scabies নামক ছত্রাকের অক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। টিউবারের গায়ে বাদামী রঙের বসে যাওয়া, উঁচু অথবা খসখসে দাগ (দাদ) দেখা যায়। 
৬। ভিতরের কালো দাগঃ অত্যাধিক তাপ ও বায়ুর স্বল্পতার জন্য আলুর মাঝখানে কিছু অংশ কালো হয়ে যায়। সাধারণত একস্থানে অনেক আলু গাঁদা করে সংরক্ষণ করলে এই রোগ হয়। 
৭। অন্তর ফাঁপা রোগঃ অপেক্ষাকৃত বড়, দ্রুত বর্ধনশীল আলু এই রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত আলুর কেন্দ্রে অসম ফাঁপা অংশ সৃষ্টি হয়। আলু গাছে টিউবার গঠনের সময় উরিমিত নাইট্রোজেন সার ব্যবহারের ফলে টিউবার দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং বর্ধিত টিউবার কোষ বিভাজনের জন্য জায়গা পায়না যার দরুণ ফাঁকা জায়গায় তৈরি হয়।
৮। আলুর সুতলি পোকাঃ আলুর সুতলি পোকার মথ আকারে ছোট, ঝালরযুক্ত, সরু ডানাবিশিষ্ট ধূসর বাদামী হয়। পূর্ণাঙ্গ কীড়া সাদাটে বা হাল্কা গোলাপী বর্ণের এবং ১৫-২০ মি.মি. লম্বা হয়ে থাকে। কীড়া আলুর মধ্যে লম্বা সুড়ঙ্গ করে আলুর ক্ষতি করে থাকে। বাংলাদেশে বসতবাড়িতে সংরক্ষিত আলু এ পোকার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৯। আলুর নরম পচা রোগঃ আরউইনা কেরোটোফোরা ছত্রাকের আক্রমণে আলুর নরম পচা রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত অংশের কোষ পচে যায়। পচা আলুতে এক ধরনের উগ্র গন্ধের সৃষ্টি হয়। চাপ দিলে আলু থেকে এক প্রকার দূষিত পানি বেরিয়ে আসে। আক্রান্ত অংশ ঘিয়ে রংয়ের ও নরম হয় যা সহজেই সুস্থ অংশ থেকে আলাদা করা যায়।
১০। আলুর শুকনো পচা রোগঃ ফিউজেরিয়াম প্রজাতির ছত্রাকের আক্রমণে আলুর শুকনো পচা রোগ হয়ে থাকে। আলুর গায়ে গভীর কালো দাগ পড়ে। আলুর ভিতরে গর্ত হয়ে যায়। প্রথম পচন যদিও ভিজা থাকে পরে তা শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। আক্রান্ত অংশে গোলাকার ভাঁজ এবং কখনো কখনো ঘোলাটে সাদা ছত্রাক জালিকা দেখা যায়।
 
রোগের প্রতিকার
১। আরলি ব্লাইটঃ সুস্থ গাছ হতে সংগৃহীত আলু  বীজ ব্যবহার করতে হবে। ফসল উঠাবার পর আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশ সমূহ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। যে জমিতে একবার রোগ হয় সেখানে পরপর ২/৩ বছর আলুর চাষ না করে অন্য ফসল চাষ করতে পারলে ভাল হয়। গাছে রোগ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে বোর্দোমিক্সার অথবা ডায়থেন এম ৪৫ স্প্রে করতে হবে। আলুর ক্ষেতের পাশে টমেটো ক্ষেত থাকলে উহাতেও স্প্রে করতে হবে।
২। লেইট ব্লাইটঃ বর্ষা আরম্ভ হওয়ার আগে আগেই শুষ্ক আলু রোগমুক্ত এলাকা হতে বীজের জন্য সংগ্র করতে হবে। অনেক সময় বীজ আলু ভাদ্রের প্রখর রৌদ্রে একমাস ভাল করে শুকাতে হয়। এর ফলে আলুতে কোন প্রকার জীবাণু থাকলে রৌদ্র তাপে তা নষ্ট হয়ে যায়। যে সকল অঞ্চলে লেইট ব্লাইট রোগ প্রায়ই হয়। যে সকল স্থানে আলুর গাছ ৮-১০ সে.মি. হলেই উহাতে বোর্দোমিক্সার বা ডায়থেন এম-৪৫ ছিটাতে হয়। পরে ২০-২৫ দিন অন্তর অন্তর ছত্রাকনাশক নিয়মিতভাবে ছিটালে রোগাক্রমণের ভয় থাকে না। রিডোমিল ০.২% হারে স্প্রে করে এই রোগ নিয়ন্ত্রন করা যায়।
৩। আলুর পাতা মোড়ানো রোগ ব্যবস্থাপনাঃ রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। কীটনাশক (এজেড্রিন, নোভাক্রন, মেনোড্রিন ইত্যাদি) ২ মিলি অথবা ১ মিলি ডাইমেক্রন প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর জমিতে সেপ্র করতে হবে। আক্রান্ত গাছ টিউবারসহ তুলে ফেলতে হবে।
৪। মৃদু মোজাইক ব্যবস্থাপনাঃ  রোগমুক্ত বীজ আলু ব্যবহার এবং এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন আলু বীজ বপন ও জাব পোকা দমন করতে হবে।
৫। কমন স্কেব ব্যবস্থাপনাঃ  এই রোগের প্রতিকারের উপায় হল- ফসল পর্যায়, শোধিত ও রোগ মুক্ত বীজ ব্যবহার, ক্ষারীয় মাটিতে আলুর আবাদ পরিহার ও জমিতে এবং নিয়মিত ও পরিমিত সেচ।
৬। ভিতরের কালো দাগ ব্যবস্থাপনাঃ  এই রোগের প্রতিকারের উপায় হল উচ্চ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ না করা ও গুদামে বাতাস চলাচলে ব্যবস্থা রাখা।
৭। অন্তর ফাঁপা রোগ ব্যবস্থাপনা: এই রোগের প্রতিকারের উপায় হল কম দূরত্বের বপন, সুষম সার ব্যবহার করা ও নিয়মিত সেচ প্রদান করা।
৮। আলুর সুতলি পোকা ব্যবস্থাপনা: বাড়িতে সংরক্ষিত আলু শুকনা বালু, ছাই, তুষ অথবা কাঠের গুঁড়ার একটি পাতলা স্তর (আলুর ওপরে ০.৫ সেন্টিমিটার) দিয়ে ঢেকে দিতে হবে৷ নিমপাতা, ল্যান্টেনা, বিষকাটালি পাতা এবং নিশিন্দা পাতা প্রতিরোধক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আলু সংরক্ষণ করার আগে সুতলি পোকা আক্রান্ত আলু বেছে ফেলে দিতে হবে। বীজ আলু গুদামে রাখার আগে বালুর সাথে সেভিন ১০% গুঁড়া ব্যবহার করতে হবে। (১ টন বালু+১ কেজি সেভিন+১.৫ টন আলু)।
৯। আলুর নরম পচা রোগ ব্যবস্থাপনা: সুস্থ ও রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে; অতিরিক্ত সেচ পরিহার করতে হবে; উচ্চ তাপ এড়ানোর জন্য আগাম চাষ করতে হবে; ভালোভাবে বাছাই করে আলু সংরক্ষণ করতে হবে; ১% ব্লিচিং পাউডার অথবা ৩% বরিক এসিডের দ্রবণে টিউবার শোধন করে বীজ আলু সংরক্ষণ করতে হবে।
১০। আলুর শুকনো পচা রোগব্যবস্থাপনাঃ আলু ভালোভাবে বাছাই করে সংরক্ষণ করতে হবে। যথাযথ কিউরিং করে আলু গুদামজাত করতে হবে। ডাইথেন এম-৪৫ দ্রবণ ০.২% দ্বারা বীজ আলু শোধন করতে হবে। বস্তা, ঝুড়ি ও গুদামজাত আলু ৫% ফরমালিন দিয়ে শোধন করতে হবে।
 
দমন পদ্ধতি/ কীটনাশক
আলু চাষ করার ক্ষেত্রে উপযুক্ত কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। 
আরও পড়ুন   মুরগির জটিল রোগ নির্ণয়ে দেশি পদ্ধতি

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে দিন

Comments are closed.

© All rights reserved © 2014 Ajkerkrishi.com
Developed By One Planet Web