আজ মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৮ অপরাহ্ন

কফি চাষ পদ্ধতি

কফি চাষ পদ্ধতি 

বাংলাদেশে উন্নত মানের চা উৎপাদনের ইতিহাস অনেক পুরনো। কিন্তু উষ্ণ পানীয়ের মধ্যে গত কয়েক দশকে কফির জনপ্রিয়তা বাড়লেও দেশে কফি চাষের ঐতিহ্য নেই। কিন্তু নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার মুন্সিপাড়া গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস কফি চাষেই সুদিনের স্বপ্ন দেখছেন। শুধুমাত্র অদম্য কৌতূহল থেকে তিনি দেশে কফি চাষের ইতিহাস বদলাতে চলেছেন।

২০০৯ সালে নার্সারি মালিক সমিতির একটি সভায় প্রথম কফি চাষের কথা শোনেন সত্তরোর্ধ্ব আব্দুল কুদ্দুস। কিন্তু কফি চাষের আগ্রহ থাকলে কি হবে, প্রথমে তো এর চারা লাগবে। কুদ্দুসের ভাষায়, “অনেক দিন থেকেই আমি এটা চাষ করতে চাইছিলাম কিন্তু চারা জোগাড় করতে পারছিলাম না।”

স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফজল কাদিরও কুদ্দুসের এই কফি প্রীতির কথা জানতেন। তিনি জানান, প্রায় সারা জীবন ধরেই তিনি কফি চাষের খুঁটিনাটি জানার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন।

অবশেষে ২০১৪ সালে কুদ্দুসের অপেক্ষার পালা শেষ হয়। তিনি বলেন, “সে বছর আমি কক্সবাজার থেকে মোট ২৫৪টি কফির চারা কিনে আনি।” কিন্তু চারা পেলে কি হবে এর চাষ পদ্ধতি নিয়ে কোন ধারণাই ছিল না তার।

“এটা কিভাবে চাষ করতে হয় জানতে আমি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অফিসে গিয়েছিলাম, কিন্তু এ নিয়ে তারা কোন আগ্রহ দেখায়নি।” এর পর শুধুমাত্র নিজের অনুমানের ওপর নির্ভর করে ১৫ শতাংশ জমিতে চারাগুলো ফাঁক ফাঁক করে রোপণ করেন কুদ্দুস।

চারা লাগানোর কিছু দিনের মধ্যেই নতুন পাতা ছাড়তে শুরু করে কফি গাছগুলো। জৈব সার পেয়ে দ্রুত বাড়তে শুরু করে সেগুলো। উচ্চতা পাঁচ ফুটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে তিনি গাছগুলো ছেঁটে দেন।

দুই বছর পর ২০১৬ সালে কফি গাছে নিজের পরিশ্রমের ফসল দেখতে পান কুদ্দুস। ফল আসতে শুরু করে কফি গাছে। সময়ের সাথে ফলগুলো পেকে কালো হয়।

তখন পর্যন্ত বিষয়টিকে বিশেষ পাত্তা দেয়নি কুদ্দুসের পরিবার। আর দিবেই বা কিভাবে। কে কবে শুনেছে নীলফামারীতে কফি চাষ হয়?

কুদ্দুসের ছেলে আকরাম বলেন, “আমরা বাবাকে নিষেধ করেছিলাম। সব চেষ্টা বৃথা যাবে এটা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তিনি ছিলেন নাছোড়বান্দা। ফল সংগ্রহ করে ঢেঁকিতে ছেঁটে খোসা থেকে কফি বীজ বের করে আনেন তিনি।”

কিন্তু এছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না কুদ্দুসের সামনে। কফি বীজ ছাঁটার জন্য বিশেষায়িত যে মেশিন থাকে সেটা তো এখানে নেই। কফি তৈরিতে তখন তার সামনে তখন একটাই উপায় ছিল আর তা হল আটা তৈরির কল। এভাবে ৬৭ কেজি কফি পাউডার তৈরি করেন তিনি।

কফি উৎপাদন সম্পর্কে ন্যূনতম প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা না থাকার পরও কুদ্দুসের কফি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। কিশোরগঞ্জ উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তা যিনি এখন নড়াইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, কিশোরগঞ্জের কফির স্বাদ ও গন্ধ আসলেই খুব ভালো।

আরও পড়ুন   হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ পদ্ধতি ও স্থাপনা নির্মাণ কৌশল

আর কুদ্দুসের কফি পান করে স্থানীয় নাগরিক কমিটির সভাপতি সাইদ হোসেন শোবুলের মনে হয়েছে আমদানি করা বিদেশি কফির তুলনায় এর স্বাদ কোন অংশেই খারাপ নয়। বরং এটাই তার বেশি ভালো লেগেছে।

কফি খেয়ে প্রশংসা করেছেন এমন লোকজনের উৎসাহে নিজের কফির লাইসেন্স করাতে রাজশাহীতে বিএসটিআই কার্যালয়ে গিয়েছিলেন আব্দুল কুদ্দুস। কিন্তু তাদের তালিকায় কফি না থাকায় তাকে ফিরে আসতে হয়। তবে নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৬ এর আওতায় জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে ‘দ্য বিসমিল্লাহ কফি’ নাম দিয়ে একটি লাইসেন্স করিয়েছেন তিনি।

নীলফামারী সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আব্দুল লতিফ জানান, আট আউন্স কফিতে ১৩৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। “ক্লান্তি দূর করে শরীর চাঙ্গা করার জন্য এটি জনপ্রিয় পানীয়। কফি গাছ ঝোপের মত হয়। মাঝারি উচ্চতার চিরসবুজ প্রকৃতির গাছ এটি।”

ঢাকায় প্রতি কেজি কফি দুই হাজার টাকা দরে বিক্রি করেছেন কুদ্দুস। এ বছর কফি থেকে তার আয় হয়েছে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। নিজের জমি থেকে কফির চারা বিক্রিও করা শুরু করছেন তিনি। স্থানীয় অনেকেই এখন প্রতিটি ২৫০ টাকা দরে তার কাছ থেকে কফি চারা কিনছেন।

১৫ শতাংশ জমি নিয়ে কফি চাষ শুরু করে এখন জমির পরিমাণ দ্বিগুণ করতে চাইছেন তিনি। কুদ্দুসের মতে, “সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে কফি উৎপাদন দেশের ভবিষ্যৎ কৃষির জন্য লাভজনক প্রমাণিত হতে পারে।

এবার দেখা যাক প্রকৃতি ব্রাজিলে কফির জন্য কি রকম অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। সাধারণত ৯০০ থেকে ১৮০০ মিটার উচ্চতায় কফি চাষ করা হয়। ভূমির ঢাল সামান্য ঢালু হলে কফি চাষের পক্ষে আদর্শ হয়। ব্রাজিলের উচ্চভূমি অঞ্চলে ৮০০ থেকে ১৭০০ মিটার উচ্চতার মধ্যে সেখানেই কফি চাষ হয়। ব্রাজিলের এই অঞ্চলে পেরারোসা জাতীয় এক প্রকার লাল মাটি রয়েছে। এই মাটি একমাত্র কফির জন্য আদর্শ। এই প্রকার মাটি নাইট্রোজেন, লোহা, পটাশ প্রভৃতি খনিজে সমৃদ্ধ হওয়ায় ব্রাজিলের কফির ফলন ও গুণগতমান অত্যন্ত বেশি হয়েছে। এখানে রোবাস্টা জাতীয় কফির চাষ হয়, যা স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়।

ব্রাজিলের জলবায়ু কফি চাষের পক্ষে অত্যন্ত সহায়ক। অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময় হল ব্রাজিলের কফির মরসুম। এই সময় কফির উপযোগী স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ও পরিমিত উষ্ণতা বজায় থাকে। ফলে গাছগুলি অল্প সময়ে দ্রুতি বৃদ্ধি পায়, প্রচুর ফল ধরে ও ফলগুলি যথেষ্ট পুষ্ট হয়।

আরও পড়ুন   মিষ্টি গাছ স্টেভিয়া চাষ পদ্ধতি

কফির চাষের একটি অন্যতম সমস্যা হল প্রখর সূর্য কিরণ। বিশ্বে অন্যান্য দেশে যেখানে কফি চাষ হয় সেখানে প্রখর সূর্য কিরণ এক অন্যতম সমস্যা। কফি যেহেতু ক্রান্তীয় উষ্ণম-লের ফসল সেহেতু এই সমস্যা থেকেই যায়। ভারতের কফি বাগিচাতে এই জন্য নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর কলা গাছ রোপন করা হয় সরাসরি সূর্যের কিরণ থেকে কফি গাছকে রক্ষা করতে। ব্রাজিলের কফি বাগিচাগুলিতে এই রকম ছায়া প্রদানকারী কোনো গাছ লাগানো হয় না। এখানকার বাগিচাগুলি উচ্চভূমির দক্ষিণমুখী ভূমিঢালে গড়ে ওঠায় সূর্যের কিরণ তির্যকভাবে পড়ে। ফলে সূর্য কিরণের প্রখরতা তেমন থাকে না। এই অঞ্চল সারা বছরই তুষার, তীব্র বায়ুপ্রবাহ,ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে একেবারে মুক্ত। এগুলি কফি চাষের ক্ষতিকর প্রভাব। অপরদিকে আটলান্টিক মহাসাগর নিকটবর্তী হওয়ায় সামুদ্রিক আর্দ্রতা, হালকা কুয়াশা কফি চাষ অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে। ব্রাজিলের এই অঞ্চলের জলবায়ু এতটাই অনুকূল যে নেমাটোড নামক কীটেরাও কফির গাছে তেমন ক্ষতি করতে পারে না।

শীত শুরু হলে ব্রাজিলের সাওপাওলো প্রদেশে বৃষ্টিপাতের মাত্রা অনেক কমে আসে। তখন পরিবেশে রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া দেখা যায়। এই আবহাওয়া কফির ফলগুলিকে শুকুতে খুব সাহায্য করে। শুকনো ফল ভেঙ্গে গুঁড়ো করে তারপর বাজারে পাঠানো হয়।

ব্রাজিলের কফির বাগানগুলিকে ফ্যাজেন্ডা বলে। এই ফ্যাজেন্ডাগুলি রেলপথে বন্দরের সঙ্গে যুক্ত। এতে বাগানে উৎপন্ন কফি সহজেই রপ্তানির উদ্দেশ্যে বন্দরে পৌঁছে যায়। এত কিছু ব্যবস্থা থেকেও মাঝে মাঝে ব্রাজিলের কফি বিরাট লোকসানের মুখোমুখি হয়। এর পিছনে অনেক কারণ আছে। সেগুলো কফি এক ফসলি কৃষি সেহেতু এর আর্থিক ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। কফির প্রতিদ্বন্দ্বী ফসল চায়ের বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলেই কফির বাণিজ্য কিছুটা ধাক্কা খায়। অনেক সময় ব্রাজিলে ব্যাপক পরিমাণে কফি উৎপাদন হয়ে গেলে তখন তার দাম বিশ্ব বাজারে পড়ে যায়।

খাগড়াছড়ির পাহাড়ে পাহাড়ে কফি চাষ

ওমর ফারুক/আব্দুল আলী, খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে : পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ির পাহাড় জুড়ে শোভা পাচ্ছে চোখ জুড়ানো কফি চাষ। পার্বত্যবাসীর কাছে কফি চাষ নতুন হলেও এখন সবার মুখে মুখে। অল্প খরচে, স্বল্প জমিতে চাষ করে অনেকেই আজ স্বাবলম্বী। তাই দিনদিন একে অপরের দেখাদেখি কফি চাষের দিকে ঝুকছে চাষীরা। খাগড়াছড়ির কফি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার বড়পিলাক গ্রামের নূর হোসেন তাঁর ৩ একর জায়গায় ধান চাষ না হওয়ায় ওই জমিতে কফি চাষ শুরু করেন। ১৯৯৯ সালে পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড তাঁকে বিনামূল্যে ২০০ কফি চারা প্রদান করে। ওই চারা দিয়ে তিনি গড়ে তুলেন ছোট একটি বাগান। চলতি বছরে তিনি ৭৫ কেজি কফি বিক্রি করে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন। কথা হয় নূর হোসেনের সাথে তিনি সংগ্রামকে জানান, পাহাড়ে কফি চাষ অনেকটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আমাদের দেখাদেখি অনেকেই কফি চাষের দিকে ঝুকছে। তিনি জানান, পাহাড়ে কফি চাষ করতে গিয়ে প্রথমে লাভ হবে কিনা বা চাষটি সফল হবে কিনা চিন্তায় ছিলাম। ৩২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী সিন্দুকছড়ি আর্মি জোনের অধিনায়ক লে: কর্নেল কামরুল হাসান এ ব্যাপারে তাঁকে সহযোগিতা করেছে বলে উল্লেখ করে বলেন, সেনাবাহিনী থেকে একটি পাম্প (সেচ যন্ত্র) দেয়া হয় তাঁকে। খাগড়াছড়ির দিঘীনালা উপজেলার বাবুছড়া এলাকার সুজন চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় গড়ে তুলেন একটি কফি বাগান। চলতি বছরে তার বাগানে বেশ ফলন হয়েছে। তাই সে খুশী। তাঁর বাগানের উৎপাদিত ৫০ কেজি কফি বিক্রি করে তিনি ২০ হাজার টাকা আয় করেছেন। তিনি বলেন, সরকারি সহযোগিতা এবং পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তিনি আরও বেশি জমিতে কফি চাষ করবেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের একাধিক কৃষকদের সাথে আলাপকালে তাঁরা জানান, খুব অল্প সময়ে কফি চাষ কৃষক প্রিয়তা পেয়েছে। কফি চাষের অভিজ্ঞতা এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাথে তাঁরা পরিচিত নয়। তাই কফির ফলন অন্যান্য জায়গার তুলনায় কম। পার্বত্য চট্টগ্রামের উর্বর মাঠিতে অভিজ্ঞতা এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা গেলে দেশের যে কোন জায়গার তুলনায় ফলন আরও ভাল হতো। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ২০০১ সালের ১২৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে পূণর্বাসন কর্মসূচির আওতায় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ৮ টি উপজেলায় কফি চাষ হচ্ছে। এরমধ্যে ১৩৫০ একর জমিতে ২০ হাজার কফি চারা রোপন করা হয়। এ কর্মসূচির আওতায় ৪৫০ টি পরিবারকে পূনর্বাসন করা হয়। এরমধ্যে বাঙ্গালী ১০০ এবং উপজাতীয় ৩০০ পরিবার। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্প পরিচালক মো.শফিকুল ইসলাম জানান, পাহাড়ে কফি বিপ্লবকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করেছেন। অল্প সময়ের মধ্যে কফি চাষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। খাগড়াছড়ির বিভিন্ন পাহাড়ে পাহাড়ে কফি চাষ ছড়িয়ে পড়ছে। এবার খাগড়াছড়ি জেলার কফি বাগানগুলো থেকে ১৫ কেজি কফি উৎপাদনের আশা করছেন। আগামীতে এর পরিমাণ ২ থেকে ৩ হাজার কেজিতে উন্নীত করতে তাঁরা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান। এ প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ি সদর উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা মো. নাছির আহাম্মদ চৌধূরী জানান, অল্প সময়ে কফি চাষের ফলন পাওয়া যায়। মাত্র ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে ফলন শুরু হয়। টানা ২০ বছর পর্যন্ত ফলন দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম কফি চাষের জন্য খুবই উপযোগী।

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে দিন

Comments are closed.

© All rights reserved © 2014 Ajkerkrishi.com
Developed By One Planet Web