স্বপ্ল পুঁজির নার্সারি ব্যবসা করবেন কীভাবে
আমাদের আজকের কৃষির ফেসবুক পেইজে অনেকেই ইনবক্সে প্রশ্ন করেন স্বপ্ল পুঁজির নার্সারি ব্যবসা করবেন কীভাবে? প্রশ্নের উত্তর খুব ছোট করে দেয়া সম্ভব না তাই একটি সম্পূর্ন আর্টিকেল তৈরি করা হলো নার্সারী উদ্যোক্তাদের জন্য।
স্বপ্ল পুঁজির নার্সারি ব্যবসা শুরুর জন্য সম্পূর্ন পোষ্টটি ভালো ভাবে পড়ুন।
পরিশ্রম আর আগ্রহের সমন্বয় ঘটাতে পারলে অবশ্যই মিলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। নার্সারি ব্যবসা থেকেও আস্তে পারে তেমন সাফল্য। বছরজুড়ে নার্সারি ব্যবসা চালান যায়। এমন কি বাড়ির ছাদেও হতে পারে নার্সারি। বর্ষাকাল নার্সারি করার উপযুক্ত সময়। ফুল, ফল, কাঠ, ঔষধি ও শোভাবর্ধনকারী-সব ধরনের গাছই নার্সারিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ছোট চারা কিংবা উদ্ভিদের কলম উৎপাদন করা হয়, রোপণের আগে যত্নসহকারে পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।
নার্সারি খাত শুধু অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সহায়তা করে না, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ রোধসহ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, খাদ্য ও পুষ্টি সমস্যা সমাধানে বহুমাত্রিক অবদান রাখে। দিন দিন নার্সারির চারার চাহিদা বাড়ছে। নার্সারি খাতের মাধ্যমে দেশের বেকার জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে স্বল্পপুঁজির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।
নার্সারি কি?
নানা ধরনের গাছগাছড়ার চারা উৎপাদন, বিতরণ বা বিক্রয়ের জন্য প্রতিষ্ঠিত বিশেষ কেন্দ্র বা স্থান। একসময় নার্সারি বলতে মূল্যবান বনবৃক্ষ এবং ফলগাছের চারা উৎপাদনকারী বিশেষ প্রতিষ্ঠানকেই বোঝানো হতো। বাগানের গাছপালার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়ে যাবার কারণে নার্সারির ধারণা এবং সেসঙ্গে তার কর্মকান্ড অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। উদ্ভিদ প্রজনন ও নতুন জাতের গাছপালা-বৃক্ষাদি ও ফল-ফুল উদ্ভাবনের কর্মসূচিও এখন নার্সারির আওতাভুক্ত। আধুনিক নার্সারি সাধারণত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্যানতত্ত্বের বিশেষজ্ঞরা দেখাশুনা করেন।
বিভিন্ন রকমের নার্সারিঃ
ফল, ফুল, বনজ, সবজি, মসলা, অর্কিড, ক্যাকটাস ও ফার্নের নার্সারিতে বিভিন্ন চারা উৎপাদন করা হয়।
নার্সারি ব্যবসার সম্ভাবনাঃ
মানুষের আয়, নগরায়ণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে রুচি ও সৌন্দর্যবোধের পরিবর্তন ঘটছে। বাড়ছে বসতবাড়ির সংখ্যা। ছায়া, বাতাস, জ্বালানি, আসবাবপত্র, ঘরবাড়ি তৈরি, পুষ্টি ও খাদ্যের প্রয়োজন মানুষ বসতবাড়ির আশেপাশে রোপণ করছে প্রচুর ফলদ, বনজ ও ভেষজ বৃক্ষের চারা। বাড়ির আশেপাশে অর্থকরী গাছপালা লাগানো পুরানো প্রথা হলেও নার্সারিতে চারাগাছ উৎপাদন বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ঘটনা।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি শুধু বনায়নের জন্য বনবিভাগ প্রথম নার্সারির প্রবর্তন করে। তারপর সরকারি তত্ত্বাবধানে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফলগাছের চারা উৎপাদনের জন্য নার্সারির প্রসার ঘটে। মধ্য-বিশ শতকে কেবল বাগানের গাছপালা উৎপাদনের লক্ষ্যে কয়েকটি বেসরকারি নার্সারি প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ দেশের বিভিন্ন স্থানে নার্সারি প্রতিষ্ঠা করে। বিগত শতকের আশির দশকে গাছপালার চাহিদা ও অর্থকরী বৃক্ষাদি রোপণের ব্যাপক আগ্রহের জন্য নার্সারি ব্যবসা বহুগুণে বেড়ে যায়।
নার্সারি ব্যবসার সুবিধাঃ
• নার্সারি ব্যবসার মৌসুম হলো বৈশাখ থেকে আশ্বিন। মূলত আষাঢ়, শ্রাবণ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে ভালো বিক্রি হয়।
• তুলনামূলক কম মূলধন লাগে।
• রোপণের জটিলতা, নিড়ানি ও চাষকালীন পরিচর্যায় ঝামেলা কম।
• লাভ বেশি।
• অল্প জায়গা ও ছোট পাত্রে রোপণ করা যায়।
নার্সারির জন্য স্থান নির্বাচনঃ
যেকোনো ব্যক্তি নিজের কর্মসংস্থানের জন্য নার্সারি ব্যবসা শুরু করতে পারেন। নার্সারীর অবস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নার্সারীটি যেন সহজেই সকলের দৃষ্টিগোচর হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। তাই এটি অবশ্যই কোন মহাসড়ক, শহর বা বাজারের পাশে অবস্থিত হতে হবে যেন নার্সারীটি খুজে বের করতে ক্রেতাদের কোন অসুবিধা না হয়। শুধু তাই নয়, সহজে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে এমন স্থানেই নার্সারী প্রতিষ্ঠা করা উচিত। নার্সারীর অবস্থান যেন কোন ঘোপের মধ্যে না হয় যেখানে সব সময় অতিরিক্ত আর্দ্র ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া থাকে।
নার্সারি ব্যবসা জন্য নির্বাচিত স্থান অবশ্যই উঁচু হতে হবে, যাতে বন্যা কিংবা বৃষ্টির পানি না জমে এবং জমির দামও তুলনামূলকভাবে কম অথচ যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল এমন স্থানে বাণিজ্যিক নার্সারী স্থাপন করলে লাভবান হওয়ার নিশ্চয়তা বেশি থাকে। অনেক জায়গায় বেশি দামেও সুবিধামত বা উপযুক্ত জমি পাওয়া যায় না। তাই নার্সারি স্থাপনের জন্য নির্বাচিত এলাকায় জমির সহজলভ্যতা এমনকি জমির দামও বিবেচনায় আনতে হবে। নার্সারীর সাথে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকতে হবে। নার্সারীতে সব সময় পানির প্রয়োজন বিধায় পানির উৎস থেকে নার্সারীর দূরত্ব বা সেচ-সুবিধা আছে কিনা তা বিবেচনায় আনতে হবে।
বাড়ির ছাদেও হতে পারে নার্সারিঃ
নার্সারির জন্য যে বিশাল জায়গা থাকতে হবে, এমন নয়। কেউ চাইলে বাড়ির ছাদেও করতে পারেন চমৎকার একটি নার্সারি। প্রায় সব ধরনের গাছই ছাদে টবে উৎপাদন করা যায়। এ ক্ষেত্রে পানি দেওয়া ও শেডের ব্যবস্থা করতে হবে। দেড় হাজার বর্গফুটের ছাদে পূর্ণাঙ্গ একটা নার্সারি করা সম্ভব। সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে বাড়ির ছাদে নার্সারি ব্যবসা করেও লাভবান হওয়া সম্ভব। বাড়ির ছাদে নার্সারির প্রশিক্ষণ নিতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে। দুই-তিন দিনের প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন বিনা মূল্যে, উপরন্তু মিলবে কিছু সম্মানীও।
নার্সারির জন্য যন্ত্রপাতিঃ
বীজতলা তৈরি, চারা উৎপাদন, চারার যত্ন ও পরিচর্যা, চারা তোলা, কলম তৈরি প্রভৃতি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। যেমন কোদাল, নিড়ানি, চালনি, নলকূপ, ভ্যান, শাবল, কাঁচি, পাইপ, ছুরি বা দা, ঝুড়ি, বদনা, বাঁশ প্রভৃতি।
নার্সারির জন্য কাঁচামালঃ
বীজ, সার, কীটনাশক, গোবর, পলিথিন প্রভৃতি।
নার্সারির জন্য চারা রোপণের পাত্রঃ
গাছভেদে ছোট থেকে বেশ বড় আকারের পাত্র ব্যবহƒত হয়। ট্রে, সিডপ্যান, পট, প্লাস্টিক পট ও ব্যাগ, বালতি, পলিব্যাগ, ড্রাম, হাফ ড্রাম, মাটির বল, টিনের কৌটা প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়।
নার্সারির জন্য নিবন্ধনঃ
বাণিজ্যিকভাবে নার্সারি ব্যবসা করার জন্য প্রথমেই দরকার নিবন্ধন। ২০১০ সালের নার্সারি আইনের আলোকে যে জমিতে নার্সারি করবেন সেই জমির কাগজপত্র অর্থাৎ নিজের হলে দলিল, ইজারা হলে তার পক্ষে কাগজপত্র, ভাড়া হলে সে-সংক্রান্ত চুক্তিনামার ফটোকপিসহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হবে। সঙ্গে যুক্ত করতে হবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অনুকূলে ৫০০ টাকার ট্রেজারি চালান। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যাঁরা রেজিস্ট্রেশন করতে চান, তাঁদের উপজেলা বা জেলা কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে আবেদন করতে হবে।
নার্সারির জন্য প্রশিক্ষণঃ
নার্সারি করার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ কারও কাছ থেকে নার্সারি ব্যবসার খুঁটিনাটি সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন। এছাড়া স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা কিংবা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে। সারা বছরই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), বাংলাদেশ বন গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিএফআরআই), ঢাকা হর্টিকালচার সেন্টার, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সারা বছর গ্রাফটিং, কাটিং, লেয়ারিং, ফলগাছ ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের আয়োজন করে।
যে কেউ চাইলেই তিন দিন, সাত দিন, ২১ দিন, এক মাস বা তিন মাস মেয়াদি এসব প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করতে পারেন নার্সারি তৈরির কাজ। এ ছাড়া সুইস ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের আর্থিক সহযোগিতায় সম্মিলিত কৃষি বনায়ন উন্নয়ন কার্যক্রম (এএফআইপি) নামে একটি প্রকল্প দীর্ঘদিন ধরে নার্সারি উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। চারা উৎপাদন, বিপণন, সংরক্ষণের বিষয়ে দরকারি সহযোগিতা দেয় তারা। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্ধারিত ফি’র বিনিময়ে কিংবা বিনামূল্যে কৃষিবিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
বাজারজাতঃ
নার্সারি ব্যবসার উপযুক্ত মৌসুম বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস। তবে ব্যবসা মূলত বর্ষাকালেই বেশি জমে। তবে নার্সারিতে সব মৌসুমের গাছ থাকে। গ্রামগঞ্জে বর্ষাকালে নার্সারি থেকে চারাগাছ তুলে বাজারে বিক্রি করা হয়। এ সময় গ্রামাঞ্চলে কাঠের গাছের ও ফলের গাছের চাহিদা আর শহরে টবের আম, কুল, সফেদা, পেয়ারা এবং বিভিন্ন রকমের ফুলের গাছের চাহিদা বেশি থাকে। নার্সারি থেকে চারা বিক্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। নার্সারি থেকে পাইকারি কিনে পিকআপ ও ভ্যানে করেও গাছের চারা ও শোভাবর্ধনকারী গাছ বিক্রি করেন অনেকে। এছাড়া হাটেও ফেরি করে বিক্রি করা যায়।
নার্সারি ব্যবসা থেকে আয় রোজগারঃ
বিনিয়োগের জন্য নার্সারি ব্যবসা একটি লাভজনক ক্ষেত্র। যদি ব্যক্তিগত পুঁজি না থাকে তাহলে মূলধন সংগ্রহের জন্য নিকট আত্মীয়স্বজন, ঋণদানকারী ব্যাংক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও)-এর সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এসব সরকারি, বেসরকারি ব্যাংক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) শর্ত সাপেক্ষে ঋণ দিয়ে থাকে। এটি এমন একটি ব্যবসা, যেখানে কখনো লোকসান হয় না।
বিভিন্ন উন্নত ও বিদেশি জাতের ফল, ফুল, ভেষজ উদ্ভিদের চারা এবং শোভাবর্ধনকারী গাছের কালেকশন রাখলে বেশ লাভবান হওয়া যায়। এ ব্যবসায় সব খরচ বাদ দিয়ে বছরে ছোট নার্সারি হলে সাধারণত এক থেকে দুই লাখ, মাঝারি আকারের হলে পাঁচ থেকে ১০ লাখ ও বড় নার্সারি হলে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লাভ হতে পারে। নিজের জমি থাকলে ২৫ হাজার টাকা দিয়েই ছোট আকারের নার্সারি ব্যবসা শুরু করা যায়। খরচ বাদ দিয়ে বছরে ৫০ হাজার থেকে শুরু করে এক কোটি টাকা পর্যন্ত লাভ হতে পারে।
পোষ্ট টি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে দিন।