গোলাপ ফুল চাষ পদ্ধতি
পরিচিতিঃ গোলাপ একটি শীতকালীন মৌসুমী ফুল। তবে বর্তমানে গোলাপ সারা বছর ধরেই চাষ করা হচ্ছে। বর্ণ, গন্ধ, কমনিয়তা ও সৌন্দর্যের বিচারে গোলাপকে ফুলের রানী বলা হয়। পুষ্প প্রেমীদের সবচেয়ে প্রিয় ফুল গোলাপ। এটি বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জলবায়ুতে খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পারে বলে পৃথিবীর সব দেশেই সারাবছর কমবেশি গোলাপের চাষ হয়। গোলাপ সাধারণত কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, বাগান, লন, কেয়ারী, বারান্দা সাজাতে গোলাপের জুড়ি নাই। আতর ও সুগন্ধি শিল্পেও গোলাপের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
গোলাপের জাতঃ গোলাপের জাত প্রধানত ৭টি। যথা-হাইব্রিড টি, হাইব্রিড পার্পেচুয়েল, পলিয়েন্থা, ফ্লোরিবান্ডা, মিনিয়েচার এবং প্লেমবার।
জমি নিবার্চনঃ পানি জমেনা এমন ধরনের মাটিতে এই ফুল ভাল হয়; তবে জৈব সার মিশ্রি্ত দো-আঁশ মাটি খুবই উপযোগী। উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি, ছায়াহীন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল, পানি সেচ সুবিধা আছে এমন এবং জমির পিএইচ মান ৬.০ থেকে ৭.৫ এর মধ্যে আছে এমন জমি।
আবহাওয়াঃ ফুলের ভাল বৃদ্ধির জন্য ৬ ঘন্টা সূর্যের আলো দরকার। তাপমাএা ১৫০ থেকে ২৫০ সেলসিয়াস থাকা ভাল।
গোলাপের চারা লাগানোর সময়ঃ গোলাপ গাছের চারা লাগানোর সময় নির্ভর করে সেই অঞ্চলের জলবায়ুর উপর । তবে আমাদের দেশে সারা বছরই লাগানো হয়। সাধারণতঃ দুই মৌসুমে এই ফুলের চাষ করা হয়ে থাকে। একর প্রতি ১২ হাজার টি চারা লাগাতে হবে।
রবি মৌসুমঃ সেপ্টেম্বরের শুরু হতে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত (ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি হতে আশ্বিন মাসের শেষ পর্যন্ত)।
খরিপ মৌসুমঃ মার্চের মাঝামাঝি হতে মধ্য এপ্রিলের মাঝ পর্যন্ত ।
লক্ষণীয়ঃ অতিরিক্ত গরম ও অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ঊভয়ই গোলাপ ফুল চাষে বাধার সৃষ্টি করে।
বংশবৃদ্ধিঃ কয়েক প্রকার বীজ থেকে গোলাপের চারা তৈরি করা গেলেও চাষের জন্য প্রধানত কলমের চারাই ব্যবহার করা হয়। সাধারণত গুটি কলম, শাখা কলম (কাটিং), চোখ কলম (বাডিং) ইত্যাদি উপায়ে গোলাপের চারা প্রস্ত্তত করা যায়।
ক. গুটিকলমঃ যে গাছের চারা তৈরি করা হবে সে গাছের একটি সুস্থ্য সবল ডালের ৩-৫ সেঃমিঃ পরিমাণ ছাল গোল করে একটি ধারালো ছুরি দিয়ে তুলে দিতে হয়। এরপর দো-আঁশ মাটি ও পচা গোবর সার সমান অংশে মিশিয়ে সেই ছালতোলা জায়গায় মুঠো করে লাগিয়ে দিতে হয়। মাটিটি পরে পরিথিন দিয়ে বেঁধে দিতে হয়। এতে মাটির জল শুকাতে পারে না, তাছাড়া শিকড় বের হলে বাইরে থেকে দেখতে সুবিধা হয়। যদি জল শুকিয়ে যায় তা হলে ইনজেকশানের সিরিঞ্জ দিয়ে জল ঢুকিয়ে দিতে হয়। ৫-৬ সপ্তাহের মধ্যেই শিকড় বের হয়। তখন পলিথিনের বাঁধনের ঠিক নিচে প্রথম দফায় অর্ধেক এবং ২/৩ দিন পর বাকি অর্ধেক আলগা করে কলমটি ২/৩ দিন ছায়ায় রেখে পরে পলিথিনের বাঁধন খুলে মাটিতে লাগাতে হয়।
খ. শাখা কলমঃ শাখা কলম তৈরির জন্য শক্ত ও নিখুঁত শাখা নির্বাচন করতে হয়। প্রায় ২০-২২ সেঃমিঃ লম্বা করে কলমের ডাল এমনভাবে কাটতে হয় যেন উপরের মাথা সমান ও নীচের মাথা অর্থাৎ সে মাথা মাটিতে পোঁতা হবে তা তেছরা থাকে। ডালের নীচের কয়েকটি পাতা ও কাঁটা ভেঙ্গে ফেলে জৈব সার মেশানো ঝুরঝুরে মাটিতে পুঁতে দিয়ে নিয়মিত জলদিতে হয়। ৬/৭ সপ্তাহ সময়ের মধ্যে কলম তৈরি হয়। সেব বিদেশী গোলাপের কাষ্ঠল অংশ কম সেগুলোতে প্রায়ই কলম হতে চায় না।
গ. চোখ কলমঃ চোখ কলম দ্বারা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বহু সংখ্যক চারা উৎপন্ন করা যায়। এ পদ্ধতিতে জংলী গোলাপ গাছের শাখা বা কান্ডের সাথে ভাল জাতের গোলাপের কুঁড়ি বা চোক লাগিয়ে তৈরি করতে হয়। এ পদ্ধতিতে দেশী জংলী গোলাপ গাছকে শিকড় গাছ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কেননা এদের ফুল ভাল মানের না হলেও দেশীয় আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকতে পারে। আষাঢ়-শ্রাবন মাসে জংলী গোলাপের ডাল কেটে কাটিং লাগাতে হয়। আমাদের দেশে কুঁড়ি সংযোজন করার উপযুক্ত সময় হচ্ছে অগ্রহায়ণের প্রথম থেকে মাঘের মাঝামাঝি পর্যন্ত।
এ পদ্ধতিতে শিকড়-গাছের বর্ধনশীল কান্ডে বা গোড়ার দিকে খুব ছোট ধারালো ছুরি দিয়ে ইংরেজী T অক্ষরের মত করে শিকড় গাছের কাটা স্থানে এমন করে বসাতে হয় যাতে কুঁড়িটি বাইরে থাকে।এভাবে কুঁড়িটি স্থাপন করে পলিথিনের চিকন ফিতা দিয়ে বেঁধে দিতে হয় এবং শিকড় গাছের অংশ কেটে ফেলতে হয়। এভাবে ৩/৪ দিন ছায়ায় রেখে পরে রোদে দিতে হবে। প্রথম কয়েক দিন এমন ভাবে জল দিতে হবে যাতে কুঁড়ির সংযোগ স্থল না ভিজে। শিকড় গাছের কোন মুকুলযাতে গজাতে বা বাড়তে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যদি গজায় তাহলে সেগুলোকে ভেঙ্গে দিতে হয। ২-৩ সপ্তাহের মধ্যেই আসল কুঁড়ি থেকে চারা বেরিয়ে আসবে। এটি বেশ কিছু বড় হলে পলিথিনের বাঁধন সাবধানে খুলে দিতে হয় যাতে গোড়ার অংশ ঠিকমত বা
জমি তৈরীঃ জমি বেশি শুকনো থাকলে হালকা সেচ দিয়ে জো আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। জৈব সার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। জমির pH ঠিক রাখার জন্য চুন অথবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সার দিতে হবে। জমিতে গভীর চাষ অর্থাৎ ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি গভীরতায় জমি চাষ দিতে হবে। পোকা মাকড় মুক্ত রাখতে জমি চাষের সময় ক্লোরডেন এবং মাটি বাহিত রোগ থেকে মুক্ত রাখার জন্য ব্রোমাইড ক্লোরোপিকরিন (১৬২ কেজি /একর) প্রয়োগ করতে হবে। শেষ চাষের সময় পরিমাণমত টিএসপি ও এমওপি সার জমিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে ।
রোপণ পদ্ধতিঃ দেশীয় গোলাপ ফুল কাটিং পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করে বেড সিস্টেমে লাগিয়ে নির্বাচিত জাতের সায়ন (যে ডাল দিয়ে কলম করা হয়) সংগ্রহ করে বিভিন্ন কলম (জোড় কলম, চোখ কলম ইত্যাদি) পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা হয়। যে চারাটি উৎপন্ন হলো, তার গোড়ায় মাটির বল তৈরী করে নির্দিষ্ট জমিতে লাগানো হয়। চারাটি লাগাতে সাধারণত: ২০ থেকে ৩০ সেমি (৮ থেকে ১২ ইঞ্চি) আয়তনের এবং ২৫ থেকে ৩০ সেমি (১০ থেকে ১২ ইঞ্চি) গর্ত তৈরী করে , তার ভিতর ভালোভাবে বসাতে হয় এবং গর্তটি মাটি দিয়ে ভালোভাবে আটকাতে হবে। যে গাছ দ্রুত বাড়ে তার জন্য ২ ফুট (গাছ থেকে গাছ) এবং ৩ ফুট (সারি থেকে সারির) দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। কলমের নীচের অংশ হতে কোন ডালপালা হতে দেওয়া যাবেনা।
সার প্রয়োগ
সারের নাম
|
পরিমাণ/একর প্রতি
|
প্রয়োগ সময়
|
কাঁচা গোবর
|
২০০০ কেজি
|
জমি তৈরির সময়
|
জৈব সার
|
৬০০ কেজি
|
জমি তৈরির সময়
|
টিএসপি
|
৫০ কেজি
|
জমি তৈরির সময়
|
এমওপি
|
২০ কেজি
|
জমি তৈরির সময়
|
ইউরিয়া
|
১০০ কেজি (প্রথম বছর)
|
চারা লাগানোর ২০ থেকে ২৫ দিন পর
|
ইউরিয়া
|
১৫ কেজি
|
কুঁড়ি বের হওয়ার পূর্বে
|
দসত্মা
|
১২ কেজি
|
জমি তৈরির সময়
|
খৈল
|
১৫০ কেজি
|
জমি তৈরির সময়
|
চাষের সময়ে পরিচর্যা
(ক) সেচ ও পানি নিষ্কাশনঃ গোলাপের চারা লাগানোর ২ থেকে ৩ দিন পরে জমিতে হালকা সেচ দিতে হবে। পরবর্তীতে ১৫ থেকে ২০ দিন পর পর সেচ দিতে হবে। জমিতে বৃষ্টির অথবা সেচের কারণে অতিরিক্ত পানি জমা থাকলে তা বের করে দিতে হবে।
(খ) আগাছা দমনঃ আগাছা ফুল গাছের কোন ক্ষতি করার আগেই তা দমন করা উচিত। আগাছা দমনে আগাছা নাশক ট্রাইফ্লুরালিন ১.৮ কেজি /একর স্প্রে করতে হবে।
(গ) ডালপালা ছাঁটাইকরণঃ গোলাপ গাছের ডালপালা ছাঁটাই করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ডালপালা ছাঁটাই-এর মাধ্যমে গাছের মৃত, দুর্বল, রোগাক্রান্ত, ও নষ্ট অংশ দূর করা হয়। যার ফলে নতুন ডালপালা জন্মে ও নতুনভাবে ভাল ফুল উৎপন্ন সম্ভব হয়।
(ঘ) মালচিং: (সাধারণত: কম্পোষ্ট, গোবর সার, খড়, কাঠের গুড়া, চালের কুঁড়া, কচুরিপানা প্রভৃতি দিয়ে ঢেকে দেওয়াকে মালচিং বলে)। গোলাপ গাছে মালচিং করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ-মালচিং মাটিকে ভেজাভেজা (আর্দ্র) রাখতে সাহায্য করে, জৈব সার তৈরিতে সাহায্য করে, আগাছা কমতে সাহায্য করে।
(ঙ) নিড়ানীঃ গোলাপ চাষের জমিতে হালকা নিড়ানী দিতে হবে । নিড়ানী দিলে গাছের মূল সহজেই আলো বাতাস,পানি পায় যার ফলে মাটির আর্দ্রতার ধারন ক্ষমতা বাড়ে এবং আগাছা মুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
জাবপোকাঃ পাতা, ডগা, ডাল, কুড়িঁ, ফুল ইত্যাদির উপর দলবেধে বসে থাকে এবং রস চুষে খায়। ফলে আক্রান্ত স্থান দুর্বল হয়ে শুকিয়ে যায়। কান্ড সরু হয়ে শাখা-প্রশাখা কমে যায় এবং গাছ নিসেত্মজ হয়ে পরে, আক্রান্ত কুঁড়ি ফোটে না ও ফুল উৎপাদন কমে যায়।
ব্যবস্থাপনাঃ প্রাথমিকভাবে গাছে দু’একটি পাতায় আক্রমন দেখা দিলে সেসব পাতা তুলে পাতার পোকা পিষে মেরে ফেলতে হবে। আধা লিটার পানিতে ১ থেকে ২টি তামাক পাতা ৩ থেকে ৪ দিন ভিজিয়ে রেখে ছেকে সেই মিশ্রণ স্পঞ্জে নিয়ে জাব পোকা আক্রান্ত স্থানে আসেত্ম আসেত্ম মুছে দিলে জাব পোকা চলে যায়। এভাবে প্রতি ১০ দিন পর ৩ বার মুছে দিলে জাব পোকা থাকে না। টবে বা বাগানে লাগানো স্বল্প কয়েকটি গাছে অল্প আক্রমণ দেখা দিলে এ পদ্ধতিতে ভাল ফল পাওয়া যায়। আক্রান্ত গাছে ১ লিটার পানিতে ৩ থেকে ৪ গ্রাম গুড়া সাবান/ডিটারজেন্ট গুলে স্প্রে করা যেতে পারে। আক্রমণ বেশি হলে ম্যালাটাফ ৫৭ ইসি বা ফাইফানন ৫৭ ইসি বা ম্যালাডান ৫৭ ইসি/পারফেকথিয়ন/স্টার্টার/টাফগর ৪০ ইসি ২ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
থ্রিপসঃ প্রথম আক্রমণ দেখা যায় ডগার নরম অংশে। পাতা বের হওয়ার আগে পাতা কুঁকড়ে যায়। কচি পাতা ও ফুলে আক্রমণ বেশি হয়। পাতার রং ফ্যাকাশে হয়ে যায়, কুঁচকে যায়, বাদামী ও কালো তিল তিল দাগ পড়ে, কুঁড়ি ভালভাবে ফোটে না। পাতা ও গাছের বৃদ্ধি কমে যায়।
ব্যবস্থাপনাঃ সব রকমের আবর্জনা ও গোবর সার বাগান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। সাবান পানি এমনকি শুধু পানি নিয়মিতভাবে বৃষ্টির মত স্প্রে করেও থ্রিপস কমানো যায়। গোলাপ বাগানে আঠাযুক্ত সাদা ফাঁদ পেতেও থ্রিপস কমানো যায়। মেটাসিস্টক্স আর ২৫ ইসি বা মিপসিন ৭৫ ডবিস্নউপি বা সুমিথিয়ন ৫০ ইসি ১ মিলি/লিটার অথবা পারফেকথিয়ন/স্টার্টার ২ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
জ্যাসিডঃ কীড়া অবস্থা থেকেই এরা পাতার রস চুষে খেতে শুরু করে। ফলে আক্রান্ত পাতা ফ্যাকাশে ও বিবর্ণ হয়ে যায়, শেষে শুকিয়ে ঝড়ে পড়ে।
ব্যবস্থাপনাঃ স্টার্টার/পারফেকথিয়ন ২ মিলি/লিটার অথবা মর্টার ৪৮ ইসি ১ মিলি/লিটার বা পাইরিফস ২০ ইসি ২ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
কুঁড়ি ছিদ্রকারী পোকাঃ এ পোকা কুঁড়ি খেয়ে নষ্ট করে। পোকার বাচ্চা বা কীড়া কুঁড়ির ভেতরের অংশ খাওয়ার পর বাইরে বেরিয়ে আসে। যে কুঁড়িতে আক্রমণ করে তার বাজার মূল্য কমে যায়।
ব্যবস্থাপনাঃ প্রথম দিকে নিমজাত নির্যাস ব্যবহার করতে হবে। জমির চারপাশে পাখি বসার ব্যবস্থা করতে হবে। নিমতেল ১ মিলিলিটার/লিটার পানি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে প্রতিলিটার পানিতে ২ গ্রাম ফিলটাপ/কাপ/কারটাপ অথবা ১ মিলি মর্টার/ ২মিলি পাইরিফস ও ১ মিলি বুস্টার/রেলোথ্রিন/রিপকর্ড একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
মাকড়ঃ পাতা থেকে রস চুষে খেতে থাকে ফলে পাতার উপরে পিঠে পিন ফুটানো দাগের মত দাগ দেখা যায়। পাতর রং হলদে বা বাদামী রঙের ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং শেষে ঝরে পড়ে।
ব্যবস্থাপনাঃ প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত পাতার কান্ড ছিড়ে ধবংস করতে হবে। টবে বা বাগানে নিম খৈল প্রয়োগ করতে হবে। শুধু পরিষ্কার পানি স্প্রে করে মাকড় দমন করা যায়। নিম্বিসিডিন বা নিমতেল ১ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। ৮০% সালফার বা থিওভিট/এগ্রিসাল/কুমুলাস ২ থেকে ৩ গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিযে স্প্রে করতে হবে। তবে এবাটিন ১.৮ ইসি ১ মিলি/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করলে বেশি সুফল পাওয়া যায়।
গোলাপের ডগা শুকানো রোগঃ ছত্রাকের কারণে রোগ হয়। কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। রোগের লক্ষণ প্রধানত: কোন ছাঁটাই করা ডালের কাটা অংশের আগায় দেখা যায়। কাটা প্রান্ত থেকে নীচে সামান্য কিছুটা অংশ শুকিয়ে কাল কাল হয়ে যায়। শুকানোর দাগ ডালটির একপাশে অথবা ডালটির চারপাশে ঘিরে বৃত্তাকারে দেখা যেতে পারে। অনুকুল পরিবেশে আক্রান্ত ডালটি পুরোপুরি শুকিয়ে কাল হয়ে যায় এবং পাতা ঝরে যায়। ডালের আগা থেকে শুকাতে শুকাতে নীচের দিকে নামতে থাকে। শেষে রোগের আক্রমণে শিকড়গুলোও শুকিয়ে যায় এবং গাছটি মারা যায়।
ব্যবস্থাপনাঃ আক্রান্ত ডাল অন্তত: পক্ষে আক্রান্ত অংশ থেকে প্রায় তিন ইঞ্চি নীচে ধারালো ছুরি বা ছুরিজাতীয় জিনিস দিয়ে কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ডাল কাটা যন্ত্রটি স্পিরিটে ডুবিয়ে শোধন করে নিতে হবে। গোলাপ ডাল ছাঁটাইয়ের পর কপার অক্সিক্লোরাইড পেস্ট আকারে মাথায় লাগাতে হবে। ছত্রাকনাশকের পেস্ট বিশেষ করে কপার অক্সিক্লোরাইড পেস্ট আকারে লাগিয়ে দিতে হবে। গোলাপ গাছে নিয়মিতভাবে সুষমমাত্রায় সার এবং সেচ প্রয়োগ করতে হবে। কপার অক্সিক্লোরাইড ৪ গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে। গাছে ফুল থাকলে কুপ্রাভিট/কপার অক্সিক্লোরাইড স্প্রে করা যাবে না। এক্ষেত্রে ম্যানকোজেব/এন্টিব্লাইট ২.৫ গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
গোলাপের পাতার কাল দাগ রোগঃ এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ এবং রোগ সংক্রমণকারী ছত্রাক ইথিলিন গ্যাস ত্যাগ করে এবং ঐ গ্যাসের প্রভাবে গাছের পাতা মরে যায় । গোলাপ গাছে এই রোগের আক্রমণ ব্যাপকভাবে দেখা দেয়। রোগের ফলে পাতার দু’পিঠে গাঢ় কাল রঙের দাড় পড়ে। কাপড়ের পাড় কোঁচকালে যেমন দেখায়, দাগের কিনারা দেখতে ঠিক সেই রকম। কোন কোন জাতের গোলাপ গাছে, রোগ সংক্রমণ শুরু হওয়ার ঠিক পর থেকে ব্যাপকভাবে পাতা ঝরতে দেখা যায়। আবার কোন কোন জাতের গোলাপ গাছ তীব্রভাবে রোগাক্রান্ত হলেও পাতা ঝরে যায় না। তীব্রভাবে আক্রান্ত পাতাগুলো (অসংখ্য দাগযুক্ত) গাছে লেগে থাকে।
ব্যবস্থাপনাঃ কাটিং ও চারা শোধন করে টবে বা বাগানে রোপণ করতে হবে। সুস্থ সবল গাছ থেকে কাটিং সংগ্রহ করতে হবে। রোগাক্রান্ত ঝরা পাতা কুড়িয়ে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। নিয়মিত যত্ন এবং প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম লিবরেল দসত্মা ও ২ গ্রাম লিবরেল বোরন একত্রে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়। এ রোগে জৈব সার প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আক্রান্ত কান্ড, ডগা ছেঁটে ফেলা এবং ছাঁটাই অংশে কপার অক্সিক্লোরাইডের পেস্ট লাগাতে হবে। কপার অক্সিক্লোরাইড ৪ গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে ৭ থেকে ১৪ দিন পর ৩ থেকে ৪ বার ভালোভাবে স্প্রে করে সম্পূর্ণ গাছ ভিজিয়ে দিতে হবে। অথবা ম্যানকোজেব/এন্টিবস্নাইট ২.৫ গ্রাম/লিটার পানিতে গুলে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করার সময় ঔষধ মিশ্রিত পানিতে ডিটারজেন্ট মিশিয়ে নিয়ে স্প্রে করতে হবে।
গোলাপের পাউডারী মিলডিউ রোগঃ ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়। মাটির উপরিভাগে অবস্থিত গাছের প্রত্যেক অংশে এই ছত্রাকের ব্যাপক সংক্রমণ ঘটে। গাছের নরম পাতাগুলো মুচড়ে যায়। আক্রান্ত পাতার কিছু অংশ উপরের দিকে উঠে যায়। আক্রান্ত অংশে পাউডারের মত গুঁড়ি গুঁড়ি বস্ত্ত দেখা যায়। আক্রমণ তীব্র হলে আক্রান্ত অংশ শুকিয়ে যায় এবং এসব স্থানে কাল দাগ পড়ে। গাছের কচি ডালের ডগাতেও গুঁড়ি গুঁড়ি বস্ত্ত দেখা যায়। আক্রান্ত ফুলের কুঁড়িগুলি ভালোভাবে ফোটে না।
ব্যবস্থাপনাঃ গাছের রোগাক্রান্ত অংশগুলি কেটে সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম থিওভিট/এগ্রিসাল বা ৮০% সালফার মিশিয়ে ১০ থেকে ১২ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার প্রয়োগ করতে হবে।
ফুল কাটাঃ চারা লাগানোর ৮০ থেকে ১১০ দিনের মধ্যে গাছে কুঁড়ি আসা শুরু হয়। কুঁড়ি অবস্থায় অর্থাৎ কুঁড়িটিতে রং দেখা যাবে কিন্তু পাঁপড়ি গুলো মেলবে না সেই অবস্থায় কাটতে হবে। ফুল কাটতে ধারালো ছুরি বা ছুরিজাতীয় জিনিস ব্যবহার করতে হবে। খুব ভোরে এবং সূর্যাসেত্মর পূর্বে ফুল কাটার জন্য উপযুক্ত সময়। ফুলের সাথে লম্বা স্টিক রাখতে পারলে বাজার দর ভাল পাওয়া যায়।
ফুল উৎপাদনঃ প্রতি বৎসরে একর প্রতি ফুল উৎপাদন হয় প্রায় ৩৭০৫০০ থেকে ৪৯৪০০০ টি।
প্রক্রিয়াজাতকরণঃ ৪০০ পিপিএম হাইড্রক্সি কুইনোলিন সাইট্রেট এর সাথে ৪% চিনির দ্রবণ মিশিয়ে তা কুঁড়ির উপর স্প্রে করতে হবে। কুঁড়িকে পলিথিন মোড়কে মুড়ে কার্টুনে রাখতে হবে। এভাবে কার্টুনটি ৪ থেকে ১০০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় তিন দিন সংরক্ষণ বা পরিবহন করা যাবে।
প্যাকিং বা মোড়কীকরণঃ গোলাপ ফুল সংরক্ষণ করতে ৩.২৮ ফুট লম্বা ১৩ ইঞ্চি প্রশসত্ম ২.৫ ইঞ্চি উঁচু বক্স তৈরী করতে হবে। এই বক্সে ২৬ থেকে ২৮ ইঞ্চি লম্বা কান্ড বিশিষ্ট ৮০ টি গোলাপ রাখা সম্ভব। বক্সের ফাঁকে ফাঁকে পলিথিন ও পানি শোষক কাগজ রাখতে হবে। ২০টা কুঁড়ি নিয়ে একটা আঁটি রাবার ব্যান্ড দিয়ে এমনভাবে বাধঁতে হবে যেন কুড়ির কোন ক্ষতি না হয়। প্রতিটি বান্ডেলের উপরি ভাগ মোড়ক কাগজ দিয়ে বেঁধে সংযুক্ত ফিতা দিয়ে আটকাতে হবে।
Post Views: 178