আজ বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ অপরাহ্ন
বাংলাদেশে আঙ্গুর ফল টক, এ কারণে যে এই ফলটি আমরা এতদিন উতপাদন করতে পরিনি। পুরোটাই আমদানী করে আনতে হয় দেশের বাহির হতে। তাই উচ্চমূল্যের কারণে বরাবরই সাধারণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। কখনও কেউ অসুস্থ হলে কিংবা কালেভ্রদ্রে সাধারণ পরিবারে আঙ্গুর খাওয়া হয়। কিন্তু আমদের মাটি ও জলবায়ু আঙ্গুর চাষের জন্য উপযোগী এটা সমপ্রতি প্রমাণিতও হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দু’চারটি আঙ্গুর গাছ থাকলেও সেটা পরিবারের আওতার মধ্যে সীমাবদ্ধ প্রতিষ্ঠানিক ভাবে আঙ্গুর চাষের চেষ্টা চালানো হয় ১৯৯০ সালে গাজীপুরের কাশিমপুরস্থ বিএডিসি’র উদ্যান উন্নয়ন কেন্দ্রে।
উপযুক্ত মাটি
আঙ্গুর চাষের জন্য জমি ও মাটি নির্বাচন দো-আঁশযুক্ত লালমাটি, জৈবিক সার সমৃদ্ধ কাঁকর জাতীয় মাটি এবং পাহাড়ের পাললিক মাটিতে আঙ্গুর চাষ ভাল হয়। জমি অবশ্যই উঁচু হতে হবে যেখানে পানি দাঁড়িয়ে থাকবে না এবং প্রচুর সূর্যের আলো পড়বে এমন জায়গা আঙ্গুর চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
জমি তৈরি
ভালভাবে চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুর করবেন তারপর ৭০ × ৭০ × ৭০ সে. মি. মাপের গর্ত করে তাতে ৪০ কেজি গোবর, ৪০০ গ্রাম পটাশ, ৫০০ গ্রাম ফসফেট এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া গর্তের মাটির সাথে মিশিয়ে ১০/১৫ দিন রেখে দিতে হবে যেন সারগুলো ভালোভাবে মাটির সাথে মিশে যায়। তারপর সংগ্রহীত চারা গোড়ার মাটির বলসহ গর্তে রোপন করে একটি কাঠি গেড়ে সোজা হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে এবং হালকা পানি সেচ দিতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আঙ্গুর চারা লাগানোর উপযুক্ত সময় মার্চ-এপ্রিল মাস।
সার প্রয়োগ
আঙ্গুর যেহেতু লতানো গাছ তাই এর বৃদ্ধির জন্য সময়মতো বাড়তি সার প্রয়োগ করতে হবে। রোপনের ১ মাসের মধ্যে বাড়তি না হলে গোড়ার মাটি আলগা করে তাতে ৫ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করা দরকার। ১-৩ বছরের প্রতিটি গাছে বছরে ১০ কেজি গোবর, ৪০০ গ্রাম পটাশ, ৫০০ গ্রাম ফসফেট এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। পটাশ সার ব্যবহারে আঙ্গুর মিষ্টি হয় এবং রোগ বালাইয়ের উপদ্রব কম হয়। গাছ বেড়ে ওঠার জন্য গাছের গোড়ায় শক্ত কাঠি দিতে হবে এবং মাচার ব্যবস্থা করতে হবে, সে মাচাতে আঙ্গুরের শাখা-প্রশাখা ছড়াবে।
পরিচর্যা
আঙুরগাছের ডাল সময়মতো ও সঠিকভাবে ছাঁটাই না করলে ফুল-ফল ধরে না। আঙুরগাছের বিভিন্ন পরিচর্যার মধ্যে একটি হলো ডাল ছাঁটাই। এই গাছের ডাল বা শাখায় ফুল ধরে। তাই এটা না করলে ফলন অর্ধেকে নেমে যায়। প্রতিবার ফুল ধরার পর ডাল বা শাখাটি পুরনো হয়ে যায় এবং ওই ডাল বা শাখায় আর ফুল-ফল ধরে না। এসব পুরনো ডাল বা শাখা গাছে থাকলে খাবারে ভাগ বসায় এবং গাছে নতুন শাখা-প্রশাখা গজাতে বাধা দেয়।
শীত আসার সাথে সাথেই আঙুরের পাতা ঝরে যায়। পুরো শীতে গাছ পাতাবিহীন অবস্খায় থাকে। শুধু কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখা দেখে মনে হয় যেন গাছটি মরে গেছে। কিন্তু বসন্ত শুরু হওয়ার পর আঙুর গাছে ফুল-ফল ধরতে শুরু করে। তবে ফল পাকতে পাকতে বর্ষা চলে এলে ফল মিষ্টি হয় না। বাংলাদেশে যেসব জাতের ফল আগে আসে এবং আগে পুষ্ট হয় সেসব জাতের কিছু ফল মিষ্টি হতে দেখা যায়। আঙুর ফল পুষ্ট হওয়ার পর পাকা অবস্খায় গাছ থেকে পাড়তে হয়। এটি লিচুর মতো আগে পেড়ে ফেললে পরে আর পাকে না। এ দেশে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে আঙুরগাছ ছাঁটাই করলে মার্চ-এপ্রিলে ফল পাওয়া যায়। তবে দেরিতে ফল সংগ্রহ করলে আকাশ একটানা মেঘলা থাকা বা বৃষ্টির কারণে ফল টক হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এর কারণ হলো গরমে আঙুর ফলে চিনিজাতীয় পদার্থ বেড়ে যায়। ফল ঠিকমতো বড় ও মিষ্টি না হলে, ফল ধরার পর প্রতি লিটার পানিতে ৫০ মিলিলিটার ইথরেল ও ১০০ মিলিগ্রাম জিবারেলিক অ্যাসিড পাউডার (জিবগ্রো ৫জি বা বারান্টো-৮০%) একত্রে মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর দুই থেকে তিনবার স্প্রে করলে উপকার পাওয়া যেতে পারে।
গাছ রোপণের প্রথম বছর হালকাভাবে ডাল ছাঁটাই করে দিতে হয়। পরের বছরে গোড়া থেকে ১.৫ মিটার উচ্চতায় গাছ কেটে দিতে হয়। প্রথম বছরে ফল নেয়ার পর ডালগুলো ১০-১৫ সেন্টিমিটার লম্বা রেখে শীতের শুরুতেই আবার কাটতে হয়। বসন্তের শুরুতে কাটা ডালগুলো থেকে অনেক চোখ ও শাখা বের হয়। এভাবে তিন-চার বছর পর্যন্ত একই গাছ থেকে ফল নেয়া যায়। এরপর যখন ডালগুলো থেকে নতুন শাখা কম গজায় বা ফুল ও ফল কম ধরে তখন মূল কাণ্ডটিকে গোড়া থেকে ৭-১০ সেন্টিমিটার উচ্চতায় কেটে দিতে হয়। সেখান থেকে নতুন ডাল গজালে সতেজ দেখে এক-দু’টি ডাল রেখে আগের পদ্ধতিতে নতুন শাখা বের করানো যায়।
ডাল ছাঁটাইয়ের পর গাছে সার দেয়া ভালো। গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য পটাশজাতীয় সারের প্রয়োজন খুব বেশি। পটাশের অভাবে গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ডাল ভঙ্গুর প্রকৃতির হয় এবং ফল ফেটে যায় ও ফলের মধ্যকার মিষ্টি কমে যায়। প্রথম বছর গাছপ্রতি ১০-১৫ কেজি জৈব সার, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ২৫০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হয়। এরপর প্রতি বছর পাঁচ কেজি জৈব সার, ১০ গ্রাম হারে ইউরিয়া ও টিএসপি এবং ২০ গ্রাম এমওপি সার দিতে হয়। পটাশ সার দু’বারে দিতে হয়। শীতের আগে ডাল ছাঁটাই করার পর অর্ধেক এবং শীতের শেষে নতুন ফল ধরতে আরম্ভ করলে বাকি অর্ধেকটুকু। জৈব সার ও টিএসপি ছাঁটাই করার পরপরই প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়ার এক-তৃতীয়াংশ ছাঁটাইয়ের সময়, এক-তৃতীয়াংশ ফল ধরার পরপরই এবং শেষটুকু ফল মাঝারি আকারের হলে গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হয়।
কান্ড ছাঁটাই
গাছের কান্ড ছাঁটাই রোপনের পরবর্তী বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে মাচায় ছড়িয়ে থাকা আঙ্গুর গাছের কান্ড ছাঁটাই করতে হবে। অধিকাংশ খামারিরই প্রশ্ন গাছে ফুল হয় কিন্তু ফল হয় না। এর কারণ কি? কান্ড ছাঁটাই এর মাধমে আঙ্গুর গাছের ফলন বৃদ্ধি হয় এবং ফুল ঝরে পড়া কমে যায়। ছাঁটাইয়ের ৭ দিন আগে এবং পরে গোড়ায় হালকা সেচ দিতে হয়। গাছ রোপনের পর মাচার ওঠা পর্যন্ত প্রধান কান্ড ছাড়া অন্য সকল পার্শ্বের শাখা ভেঙ্গে ফেলতে হবে।
প্রথম ছাঁটাই
মাচায় কান্ড ওঠার ৩৫/৪৫ সে.মি. পর প্রধান কান্ডের শীর্ষদেশ কেটে দিতে হবে যাতে ঐ কান্ডের দুই দিক থেকে দুটি করে চারটি শাখা গজায়।
দ্বিতীয় ছাঁটাই
গজানো চারটি শাখা বড় হয়ে ১৫-২০ দিনের মাথায় ৪৫/৬০ সে.মি. লম্বা হবে তখন ৪টি শীর্ষদেশ কেটে দিতে হবে যেখানে থেকে আরও পূর্বের ন্যায় দুটি করে ১৬টি প্রশাখা গজাবে।
তৃতীয় ছাঁটাই
এই ১৬টি প্রশাখা ১৫/২০ দিনের মাথায় ৪৫/৬০ সে.মি. লম্বা হবে তখন আবার এদের শীর্ষদেশ কেটে দিতে হবে যাতে প্রতিটি প্রশাখরে দুদিকে দুটি করে ৪টি নতুন শাখা এবং এমনিভাবে ১৬টি শাখা থেকে সর্বমোট ৬৪টি শাখা গজাবে। অবশ্য সর্বক্ষেত্রেই যে ৬৪টি শাখা গজাবে এমন কোনো কথা নেই। এই শাখার গিরার মধ্যেই প্রথমে ফুল এবং পরে এই ফুলমটর দানার মত আকার ধারণ করে আঙ্গুল ফরে রূপান্তরিত হবে। প্রথম বছর ফল পাবার পর শাখাগুলোকে ১৫/২০ সে.মি. লম্বা রেখে ফেব্রুয়ারী মাসে ছেঁটে দিতে হবে ফলে বসন্তের পক্কালে নতুন নতুন শাখা গজাবে এবং ফুল ধরবে। এই পদ্ধতি ৩/৪ বছর পর্যন্ত চলবে এবং ফলের স্থিতি লাভ করবে।
আঙুরের ফলন বাড়াতে করণীয়
আঙুর একটি অতিলতানো গাছের ফল। শাখা-কলমের বেলায় প্রায় এক ফুট দীর্ঘ শাখা-খণ্ডের এক-তৃতীয়াংশকে মাটির নিচে কাত করে পুঁতলে ভালো হয়। বয়স্ক গাছের জন্য প্রতি বছর এপ্রিল মাসে দুই কেজি তেলের খৈল, এক কেজি হাড় চূর্ণ এবং এক পোয়া সালফেট অব পটাশ ব্যবহার মন্দ নয়। কারও কারও মতে ইউরিয়া, সুপার ফসফেট ও মিউরেট অব পটাশের ১:৩:৩ অনুপাতে মিশ্রণ ব্যবহার উত্তম। ছোট চারা গাছের জন্য এ মিশ্রণের প্রায় দুই ছটাক এবং বেশ বয়স্ক গাছের জন্য প্রায় এক কেজি পর্যন্ত প্রয়োগ করা যেতে পারে।
চারা পরস্পর থেকে ১০ ফুট দূরে রোপণ করা যেতে পারে। আঙুরের জন্য একটি শক্তিশালী প্রধান কাণ্ড গঠন আবশ্যক। এর যেসব শাখা জন্মে তার গায়ে ফল-পল্লব দেখা যায়। সাধারণত ফল সংগ্রহের পর যখন পাতা ঝরে যায় তখন শাখা ছাঁটাই করা হয়। সব শাখাকেই এমনভাবে ছেঁটে দেয়া যেতে পারে, যাতে ওটার গায়ে কেবল দুই থেকে তিনটি চোখ বাকি থাকে। যেসব শাখা অতি শক্ত হয়ে যায় তার অধিকাংশই কাটা যেতে পারে। ফলের গুচ্ছ থেকে কিছু কিছু ফল কাঁচি দ্বারা কেটে পাতলা করে দিলে ফল উত্কৃষ্ট হয়। এপ্রিল-মে মাসে ফুল দেখা দেয় এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ফল পাকে। গাছপ্রতি ১০ থেকে ১৫ কেজি আঙুর পাওয়া যায়।
সরকারি পর্যায়ে আঙুর উত্পাদনের প্রচেষ্টার শুরু হয় ১৯৯১ সালে বিএডিসির কাশিমপুর উদ্যান কেন্দ্রে। উক্ত প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশে আঙুরের চাষ, উত্পাদন ও বাজারজাতকরণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। স্বল্প পরিমাণ প্রশিক্ষণই প্রায় যে কোনো গৃহস্থকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে আঙুরের উত্পাদনে।
আঙুরের চাষ হতে পারে:
১। গার্হস্থ্য পর্যায়ে,
২। মাঠে এককভাবে এবং
৩। মিশ্র ফল বাগানের অন্যতম ফল গাছরূপে।
এর রোপণ দূরত্ব ১০ ফুটের মতো, সে কারণে এটি আম কিংবা কাঁঠালভিত্তিক মিশ্র ফল বাগানের তৃতীয় সদস্যরূপে স্থান পেতে পারে। আঙুর গাছ দীর্ঘায়ু হওয়ার ফলস্বরূপ আম, কাঁঠাল, নারকেল, খেজুর, তাল ইত্যাদির মতোই মানুষ এর ফল ভোগ করতে পারে একরূপ বংশ পরম্পরায়।
যেহেতু আঙ্গিনা,বাগানে আঙুরের আবাদের জন্য বেশি জায়গা বা অর্থের দরকার হয় না, সেহেতু দরিদ্র চাষীভাই অল্প জায়গা থেকেই অধিক আয় করতে পারেন। আঙুর গাছ দীর্ঘদিন বাঁচতে পারে (শত বছরের বেশি) এবং পরিচর্যায় তেমন উল্লেখযোগ্য খরচ নেই।
আমাদের দেশে এ যাবত্ তিনটি উত্পাদনশীল আঙুর গাছের জাত নির্বাচন করা হয়েছে।
১। জাককাউ
২। ব্ল্যাক রুবী ও
৩। ব্ল্যাক পার্ল।
তিনটি জাতই গ্রীষ্মকালীন এবং পরে তিনটি রংয়ে রূপান্তরিত হয়ে যথাক্রমে হালকা বাদামি, কালো ও করমচা রং ধারণ করে। ফলন আসতে সময় লাগে প্রায় দু’বছর। মিষ্টতার পরিমাণ ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। মাটির পিএইচ ৬.৫-৭.৫ হলে আঙ্গুর দ্রুত মিষ্টি হয়। গাছের দীর্ঘায়ু বিবেচনা করে মাচায় লোহার তারের ব্যবস্থা করা ভালো। মাচায় ওঠা পর্যন্ত আঙুর গাছের পার্শ্ব শাখা ভেঙে দিতে হবে। আর যা যা করবেন তা হলো মাচায় প্রথম ডগা উঠবার মুহূর্তে তা ভেঙে দিতে হবে যাতে কর্তনকৃত অংশের নিচ থেকে দুটি কচি ডগা ইংরেজি ‘ভি’ আকারে মাচায় ওঠে এবং ৫০ সেন্টিমিটার লম্বা হবে।
দুটি ডগার মাথা পুনরায় ৫০ সেন্টিমিটার দূরে ভেঙে দিতে হবে, যাতে প্রতি শাখার উভয় পার্শ্বে অনধিক দুটি করে চারটি প্রশাখা গজায় এবং তা পুনরায় ৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড় হবে। উত্পাদিত আটটি প্রশাখা ৫০ সেন্টিমিটার বড় হওয়ার পর তা আবার মাথা ভেঙে দিতে হবে এবং এরপর গাছ যথারীতি বড় হতে থাকবে।
গাছ রোপণের উপযুক্ত সময় মার্চ থেকে মে। তবে আগস্ট মাস পর্যন্ত রোপণ করা যাবে। এরপর গাছের সতেজতা কমে যাবে। অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত গাছ ঘুমন্ত অবস্থায় থাকবে এবং পাতা ঝরে যাবে। বছরে দু’বার ফুল আসবে। মার্চ ও জুলাই মাসে তা আঙুরে রূপান্তরিত হবে। ফুল আসার পর থেকে আঙুর মিষ্টি হতে সময় লাগবে ১২০ দিন বা চার মাস। নির্দিষ্ট সময়ের আগে আঙুর কাটলে ‘টক’ লাগবে। ফুল আসার ৭০-৮০ দিনের মধ্যে সবুজ অবস্থায় আঙ্গুর স্পঞ্জের ন্যায় নরম হবে। এটা আঙুরের পরিপকস্ফতা বুঝায়। পরবর্তীকালে ৪০ দিন সময় নিবে আঙুর মিষ্টির পর্যায়ে যেতে।
৭০-৮০ দিনের সময় গাছপ্রতি ২০ গ্রাম পটাশ পানির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে আঙুর দ্রুত মিষ্টির পর্যায়ে চলে যায়। ফুল থেকে আঙুর মুগ ডালের মতো আকার হলে জিবরেলিক এসিড ছিটিয়ে প্রয়োগ করলে আকারে ও আকৃতিতে বড় হয়। ফুল থাকা অবস্থায় কীটনাশক ওষুধ প্রয়োগ নিষেধ। আঙুরের থোকায় হাত লাগানো উচিত নয়, এতে চামড়ার উপরের সাদা পাউডার হাতের ছোঁয়ায় উঠে যায় এবং পোকার আক্রমণ সহজতর হয়। থোকায় আঙুর যখন মুগ ডালের আকারে থাকে তখন ছোট অবস্থায় কিছু আঙ্গুর বাছাই করে ফেলে দেয়া ভাল যাতে আঙ্গুরের সাইজ সুন্দর থাকে। আঙ্গুর পাকার সময় বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা থাকায় মাচার উপরে ‘পলিথিন সীট’ দিয়ে আবৃত করে দিতে হবে যাতে গাছে বৃষ্টির পানি না লাগে। লাগলে পাকা আঙ্গুর ফেটে যাবার সম্ভাবনা থাকে। প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট সময়ে তিনটি কাজের পরিচর্যা নিয়মিতভাবে করতে হবে।
প্রধান পরিচর্যা
ক। প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মদ্যে গাছের গোড়ায় মাটি হালকাভাবে কুপিয়ে আলগা করে তাতে অনুমোদিত সার প্রয়োগ করে শুধুমাত্র একবার বেশি করে পানি দিতে হবে।
খ। জানুয়ারি মাসের ৪র্থ সপ্তাহে ঘুমন্ত গাছের শাখা-প্রশাখা ছাটাই করে দিতে হবে। ছাটাইকৃত ডালগুলো কেটে পরে মাটিতে পুতে পানি দিলে পুনরায় নতুন গাছ হবে।
গ। ফেব্রুয়ারি মাসের ১ম সপ্তাহে সামান্য গরম আরম্ভ হবার সাথে সাথে গাছের গোড়ায় পানি সেচ দিতে হবে, যে পর্যন্ত না বৃষ্টি হয়। পানি দেবার ১০ দিনের মধ্যে গাছে নতুন শাখা-প্রশাকা গজাবে এবং তাতে ফুল দেখা দিবে যা পরবর্তীতে আঙ্গুরে রূপান্তরিত হবে।
পরিমিত সার এবং উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে একটি আঙ্গুর গাছ না হলেও ৩০ বছর ফলন দিতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে প্রতি একরে ৪৩৬টি আঙ্গুর গাছে লাগানো যায় এবং জাতিতে ভিন্নতায় গড়ে প্রতি গাছে প্রতিবছর ৪ কেজি হিসাবে মোট ১৭৪৪ কেজি আঙ্গুর এক একরে উৎপাদন করা সম্ভব।
একটি হিসাব করে দেখা গেছে, কৃষকের বসত ভিটার ৯ বর্গমিটার জায়গায় ৪টি গাছ লাগিয়ে বছরে সর্বোচ্চ তিনটি ফলনের মাধ্যমে ১৬ কেজি আঙ্গুর উৎপাদন করা সম্ভব। লাউ, সীম, কুমড়া এখন বসত ভিটার আঙ্গিনা থেকে বাণিজ্যিকভাবে মাঠ পর্যায়ে চাষ হচ্ছে, অতএব বসত ভিটার ঐ মাচাটি এখন চাইলে আমরা আঙ্গুর মাচায় রূপান্তরিত করতে পারি। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন হচ্ছে কৃষক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী খামার স্থাপন, চারা উৎপাদন, বিতরণ এবং জোর প্রচারণা।