আজ শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০০ পূর্বাহ্ন

লেবু গাছের বিভিন্ন ধরণের রোগবালাই ও তাঁর প্রতিকার

লেবু গাছের বিভিন্ন ধরণের রোগবালাই ও তাঁর প্রতিকার

লেবু গাছের বিভিন্ন ধরণের রোগবালাই ও তাঁর প্রতিকার

 

লেবু গাছের বিভিন্ন ধরণের রোগবালাই

লেবু আমাদের দেশে একটি অর্থকারী ফসল। লেবু চাষ করে বর্তমানে আমাদের দেশের কৃষকেরা অনেক লাভবান হচ্ছেন। তবে লেবু চাষ করার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। লেবুর ক্ষেতে বিভিন্ন ধরণের রোগ বালাইয়ের আক্রমণ হয়। আসুন জেনে নেই লেবুর কিছু রোগবালাই ও তাঁর প্রতিকার সম্পর্কে।

লেবু গাছের বিভিন্ন রোগের লক্ষণ ও বর্ণনা

১। এনথ্রাকনোজ (Anthracnose) রোগঃ

ক) পুরনো পাতা অথবা সব পাতা কিছুটা পুরনো হয়েছে এমন ধরণের পাতায় প্রথমে ঈষৎ সবুজ রঙের দাগ পড়ে। এই সবুজ দাগ খুব শীঘ্রই বাদামী হয়ে যায়।

খ) এনথ্রাকনোজ রোগ পাতার আগায় ও কিনারায় বেশী হয়। এই রোগে আক্রান্ত গাছ আগা হতে শুরু করে নীচের দিকে আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়।

গ) ডাল শুকানোর সঙ্গে সঙ্গে পাতা ঝরে পড়ে এবং মাঝে মাঝে পাতা ঝরে পড়ার আগে ডাল শুকিয়ে যায়। এই রোগের প্রকোপ বেশী হলে বড় ডালগুলি রোগা হয়ে যায় এবং হলুদ বর্ণ ধারণ করে।

ঘ) এই রোগ আস্তে আস্তে গাছের পাতা থেকে ফলের বোঁটায়ও এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে। বোঁটা আক্রান্ত হলে তা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ফল ঝরে পড়ে।

আরও পড়ুন   আমের মুকুল বিকৃতি রোগ দমন

ঙ) Gloeosporium limiticolum ও Celletotrichum gloeosporoides নামক ছত্রাকদ্বয়ের আক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে।

লেবু গাছের বিভিন্ন রোগের লক্ষণ ও বর্ণনা

২। শিকড় পচা (Root rot) রোগঃ

ক) বীজতলার চারা গাছে এই রোগ বেশী হয়। এই রোগে আক্রান্ত গাছের শিকড়ের বাকল নরম হয়ে যায়।

খ) বাকলের ভিতরের অংশ এবং কাঠের উপরের অংশ কালো হয়ে যায়। প্রথমে গাছের শাখা শিকড়ে পচন ধরে এবং পরে প্রধান শিকড়ও নষ্ট হয়ে যায়।

গ) চারা গাছে এই রোগের আক্রমণ হলে তা নেতিয়ে পড়ে এবং বড় গাছে আক্রমণ হলে তা ঢলে পড়ে। Macrophomina phaseolina এবং Rhizoctonia bataticola নামক ছত্রাকের আক্রমনে এই রোগ হয়ে থাকে।

৩। ক্যাঙ্কার (Canker) রোগঃ

ক) এই রোগে আক্রমনের ফলে গাছের বাড়ন্ত সতেজ কচি কচি পাতায় প্রথমে হালকা হলুদ রঙের দাগ পড়ে। রোগের আক্রমণের প্রাথমিক দিকে এই দাগগুলি আলপিনের মাথার মত থাকে।

খ) এই রোগাক্রমণের কয়েকদিনের মধ্যে আক্রান্ত স্থানের তন্তু ঈষৎ সাদা রঙের ফোস্কার মতো উঁচু হয়ে বের হয়ে আসে। রোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত অংশের তন্তুর রঙ প্রথমে সাদা এবং পরে বাদামী হয়ে যায়।

গ) পরে এই দাগের মত তন্তু মরে যায় এবং মাঝে মাঝে এই মরা অংশ শুকিয়ে যায়। Xanthomonas citri নামক ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে।

৪। স্ক্যাব (Scab) রোগঃ

ক) লেবু গাছের পাতায়, কচি কচি ডালে ও ফলে এই রোগ হয়ে থাকে। পাতা পরিপূর্ণভবে মেলার আগেই এর উপর ছোট ছোট ঈষৎ স্বচ্ছ ধরণের দাগ পড়ে।

খ) এই রোগাক্রমণের কয়েকদিনের মধ্যে আক্রান্ত স্থানের তন্তু ঈষৎ সাদা রঙের ফোস্কার মতো উঁচু হয়ে বের হয়ে আসে। পাতার ও দাগের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দাগের আকৃতি ও রঙ বদলাতে থাকে।

গ) নতুন দাগ দেখতে অনেকটা মাংসের মত এবং পুরনো হলে তা ধূসর ও মলিন হয়ে যায়। রোগাক্রান্ত পাতার অংশটুকু মরে যায় এবং অনেক সময় পাতা হতে খসে পড়ে।

আরও পড়ুন   ব্রোকোলির টোবাকো ক্যাটারপিলার পোকা দমন

ঘ) পাতার ন্যায় ডালপালার উপরও স্ক্যাব রোগ ছোট ছোট ফোস্কার আকার নিয়ে বের হয়ে আসে। Elsinoe fawectti নামক ছত্রাকের আক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে।

৫। আঠা হওয়া (Gummosis) রোগঃ

ক) এই রোগের প্রাথমিক অবস্থায় কাণ্ডের গোড়ার দিকে বড় বড় পানি ভেজা দাগ দেখা যায়। শীঘ্রই এই দাগগুলি বাদামী রঙ ধারণ করে এবং কাণ্ডের বাকলে ফাটল দেখা যায়।

খ) পরবর্তীতে এই ফাটল হতে আঠাজাতীয় পদার্থ বের হয়ে আসে। রোগ আরও বিস্তৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপরের শাখা প্রশাখায় আঠা জমতে থাকে।

গ) এই রোগে আক্রান্ত গাছ ধীরে ধীরে হলুদ হয়ে যায়। আবার অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় গাছ হলুদ হয়ে যায়।

ঘ) এই রোগে আক্রান্ত গাছের ফল ছোট হয়। Phytophthora নামক ছত্রাকের একাধিক প্রজাতির আক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে।

লেবু গাছের বিভিন্ন রোগের প্রতিকার সম্পর্কে:

১। এনথ্রাকনোজ (Anthracnose) রোগঃ

ক) এই রোগ নিয়ন্ত্রনের জন্য নীরোগ বীজতলায় চারা উৎপাদন করে পরে তা রোগমুক্ত জমিতে রোপন করতে হবে।

খ) জানুয়ারি মাসে একবার ও সেপ্টেম্বর মাসে আর একবার ৪ : ৪ : ৫০ অনুপাতে রোজিন বোর্দোমিক্সচ্যার গাছে ছিটাতে হবে।

গ) গাছের শিকড়ের চারপাশে উপযুক্ত সার ও নিয়মিত সেচ দিতে হবে। অতিরিক্ত গরম বাতাস যে দিক হতে আসে সেই দিকে অন্য গাছ লাগিয়ে বেড়া দেয়া উচিৎ।

ঘ) ফল সংগ্রহের পর প্রতি বৎসর আক্রান্ত অংশ ছেঁটে ফেলতে হবে। ছাটা অংশগুলি সাবধানে সংগ্রহ করে মাটি চাপা দিতে হবে।

২। শিকড় পচা (Root rot) রোগঃ

ক) বীজ বপন করার পূর্বে বীজতলার মাটি এবং গাছ লাগানোর পূর্বে গর্তের মাটি ফরমালিন দ্বারা শোধন করে নিতে হবে।

খ) গাছের গোড়া যেন ভেজা না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ গাছের গোড়া ভেজা থাকলে রোগের জীবাণু দ্রুত বিস্তার লাভ করে

আরও পড়ুন   মিষ্টি কুমড়ার ব্লোজম এন্ড রট রােগ দমন পদ্ধতি


গ) ফরমালিন মিশ্রিত পানি সেচের পরে গাছের গোড়া কলা গাছের পাতা দ্বারা ঢেকে রাখতে হবে।

৩। ক্যাঙ্কার (Canker) রোগঃ

ক) উপযুক্ত চারার জন্য রোগমুক্ত এলাকা হতে নীরোগ চারা সংগ্রহ করতে হবে। যে সকল বাগানে ক্যাঙ্কার রোগের আক্রমণ নতুন ভাবে দেখা দেয় সেসব বাগানের গাছ সমূলে উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

খ) লেবু গাছে নতুন পাতা ও ডাল বের হওয়ার পর আক্রান্ত অংশসমূহ যথাসম্ভব ছেঁটে ফেলতে হবে। গাছ ছাঁটাই করার পরে গাছে ছত্রাকনাশক ছিটাতে হবে।

গ) ফল ধরার ২-৩ মাস পরে ৫ : ৫ : ৫০ অনুপাতে বোর্দোমিক্সচ্যার ছিটিয়ে দিতে হবে। তবে মনে রাখবেন বোর্দোমিক্সচ্যারে চুনের পরিমাণ একটু বেশি হলে ভাল হয়।

ক্যাঙ্কার (Canker) রোগঃ

 

৪। স্ক্যাব (Scab) রোগঃ

ক) রোগদূষিত পাতা, ডাল ও ফল সতর্কতার সাথে কুড়িয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে

খ) বসন্ত কালে নতুন পাতা গজানোর আগে একবার ও ফুল ফোটার পর এর দুই তৃতীয়াংশ পাপড়ি ঝরে পড়ার পর বোর্দোমিক্সচ্যার বা অন্য কোন ছত্রাকনাশক ছিটিয়ে দিতে হবে।

৫। আঠা হওয়া (Gummosis) রোগঃ

ক) এই রোগে আক্রান্ত অংশ ভালভাবে চেঁছে ছত্রাকনাশকের পেস্ট লাগাতে হবে। এছাড়াও সেচের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন গাছের গোড়ায় পানি স্পর্শ না করে।

খ) গ্রাফটিং (grafting) বা জোড়কলম পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করতে হয়। গ্রাফটিং এর সময় রোগ প্রতিরোধী জাতের লেবুগাছের গোড়া ব্যবহার করতে হবে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে দিন

Comments are closed.

© All rights reserved © 2014 Ajkerkrishi.com
Developed By One Planet Web