আজ মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৫ অপরাহ্ন
হাইড্রোপনিক (Hydroponic) হলো মাটি ছাড়া পানিতে ফসল উৎপাদনের ( বিশেষ করে সবজি) চাষের আধুনিক পদ্ধতি। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাটির পরিবর্তে পানিতে গাছের প্রয়াজনীয় খাবার সরবরাহ করে ফসল উৎপাদন করা যায়। উন্নত বিশ্বে মাটি ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে সবজি চাষ বেশ জনপ্রিয়
। মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মরুভূমিতে মাটি ছাড়া সবজি চাষ করে শত শত কোটি টাকা আয় হচ্ছে। বাংলাদেশে আগে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে সবজি চাষ হয়নি। তবে বর্তমানে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে মাটি ছাড়া সবজি চাষ। বিশেষ করে ঢাকার দোহারে এ ধরনের একটি সবজি খামারের সাফল্য সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে মিজানুর রহমান।
আধুনিক প্রযুত্তি কাজে লাগিয়ে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে শুধু পানি ব্যবহার করে উৎপাদন করা হচ্ছে নানা ধরনের দেশি-বিদেশি ফল ও শাক-সবজি। এই পদ্ধতিতে সারাবছর সবজি ও ফল উৎপাদন সম্ভব। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজি ও ফলে কোন কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। ফলে এসব সবজি পোকামাকড় বা কীটনাশকমুক্ত, স্বাস্থ্য ও মান সম্মত।
যেসব ফসল এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায় সেগুলো হলো- ১। পাতা জাতীয় সবজি- লেটুস, গিমা কলমি, বিলাতি ধনিয়া, বাঁধাকপি ইত্যাদি। ২। ফল জাতীয় সবজি- টমেটো, বেগুন, ক্যাপসিকাম, ব্রোকলি, ফুলকপি, শসা, খিরা, মেলন, স্কোয়াস ইত্যাদি। ৩। ফল জাতীয় – স্ট্রবেরী ( Strawberry) ৪। ফুল জাতীয়- এন্থরিয়াম, গাঁদা, গোলাপ, অর্কিড, জারবেরা, চন্দ্রমল্লিকা ইত্যাদি।
দুটি উপায়ে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায়।
১। সঞ্চালন পদ্ধতি (Circulating System)
২। সঞ্চালন বিহীন পদ্ধতি (Non Circulating System)
এ পদ্ধতিতে গাছের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদানসমূহ যথাযথ মাত্রায় মিশ্রিত করে একটি ট্যাংকিতে নেওয়া হয়। এরপর পাম্পের সাহায্যে পাইপের মাধ্যমে ট্রেতে পুষ্টি দ্রবণ (Nutrient Solution) সঞ্চালন করে ফসল উৎপাদন করা হয়।
প্রতিদিন অন্ততপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা পাম্পের সাহায্যে এই সঞ্চালন প্রক্রিয়া চালু রাখা দরকার। এই পদ্ধতিতে প্রাথমিকভাবে প্রথম বছর ট্রে, পাম্প এবং পাইপের আনুসাঙ্গিক খরচ একটু বেশি হলেও পরবর্তী বছর থেকে শুধু রাসায়নিক খাদ্য উপাদানের খরচ প্রয়োজন হয়। ফলে দ্বিতীয় বছর থেকে খরচ অনেকাংশে কমে যাবে।
এই পদ্ধতিতে গ্যালভানাইজিং লোহার তৈরি ট্রে টি একটি Stand এর উপর স্থাপন করে প্লাস্টিক পাইপের সাহায্যে একটি ট্যাংকের সাথে যুক্ত করা হয়। এই ট্যাংক থেকে পাম্পের সাহায্যে রাসায়নিত দ্রব্য মিশ্রিত জলীয় খাদ্য দ্রবণ ট্রেতে সঞ্চালন করা হয়। গ্যালভানাইজিং লোহার ট্রের উপর কর্ক সীটের মাঝে গাছের প্রয়োজনীয় দূরত্ব অনুসারে যেমন, লেটুস ২০ x ২০ সেমি, টমেটো ৫০ x ৪০ সেমি এবং স্ট্রবেরী ৩০ x ৩০ সেমি দূরত্বে গর্ত করতে হয়।
উপযুক্ত বয়সের চারা স্পঞ্জ (Sponge) সহ ঐ গর্তে স্থাপন করতে হয়। চারা রোপনের পর ট্যাংক থেকে ট্রের মধ্যে জলীয় দ্রবণ পাম্পের সাহায্যে প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ ঘন্টা সঞ্চালিত করে গাছের অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করা হয়। ট্রেতে কমপক্ষে ৬-৮ সেমি পানি সব সময় রাখতে হবে। সাধারণত প্রতি ১২-১৫ দিন অন্তর জলীয় দ্রবণ ট্রেতে যোগ করতে হবে। এই পদ্ধতি সবজি উৎপাদনে pH এবং EC মাত্রা ফসলের চাহিদার মধ্যে রাখতে হয়।
সাধারণভাবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে উৎপাদনের জন্য pH ৫.৮-৬.৫ এর মধ্যে রাখতে হয়। যদি pH এর মাত্রা ৭.০ এর উপরে হয় তবে আয়রন, ম্যাংগানিজ মলিবডেনামসহ অন্যান্য মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের অভাব পরিলক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রে হাইড্রোক্লোরাইড এসিড (HCL) অথবা ফসফরিক এসিড (HPO4) বা নাইট্রিক এসিড (HNO3) দিয়ে pH কে কাঙ্খিত মাত্রায় রাখতে হবে।
আবার pH যদি ৫.৮ এর বেশি নিচে নেমে যায় তখন NaOH অথবা KOH দিয়ে pH নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। EC এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে জলীয় দ্রবণে খাদ্য উপাদানের উপস্থিতির মাত্রা সাধারণত EC ১.৫-২.৫ ds/m এর মধ্যে রাখতে হবে। EC এর মাত্রা যদি ২.৫ ds/m উপরে চলে যায় সে ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ পানি যোগ করতে হবে। প্রতিদিন সকাল ও বিকালে pH এবং EC সমন্বয় করতে হবে।
এই পদ্ধতিতে একটি ট্রেতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানসমূহ পরিমিত মাত্রায় সরবরাহ করে সরাসরি ফসল উৎপাদন করা হয়। এই পদ্ধতিতে খাদ্য উপাদান সরবরাহের জন্য কোন পাম্প বা পানি সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে খাদ্য উপাদান মিশ্রিত দ্রবণ ও উহার উপর স্থাপিত কর্কশীটের মাঝে ৫-৭ সেমি পরিমাণ জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে এবং কর্কশীটের উপরে ৪-৫ টি ছোট ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে যাতে সহজেই বাতাস চলাচল করতে পারে এবং গাছ তার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কর্কশীটের ফাঁকা জায়গা থেকে
সংগ্রহ করতে পারবে। ফসলের প্রকারভেদে সাধারণত ২-৩ বার এই খাদ্য উপাদান ট্রেতে যোগ করতে হয়। এই পদ্ধতিতে কোন বৈদ্যুতিক মটর, পাম্প বা পাইপ ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। এই পদ্ধতি অনুসরণ আগ্রহী কৃষকগণ সহজেই প্লাস্টিক বালতি, পানির বোতল, মাটির পাতিল, ইত্যাদি ব্যবহার করে বাড়ির ছাদ, বারান্দা এবং খোলা জায়গায় সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন করতে পারে। এতে খরচ তুলনামূলকভাবে কম হবে।
জলীয় খাদ্য দ্রবণ তৈরিতে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রবের পরিমাণ ও প্রস্তুত প্রণালী পদ্ধতি নিচে বর্ণনা করা হলো-
পানিতে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্য সমূহের পরিমাণ (প্রতি ১০০ লিটার পানির জন্য)
ক্রমিক নং | রাসায়নিক উপাদান | পরিমাণ |
১ | পটাশিয়াম হাইড্রোজেন ফসফেট (KH2PO4) | ২৭.০ |
২ | পটাশিয়াম নাইট্রেট (KNO3) | ৫৮.০ |
৩ | ক্যালসিয়াম নাইট্রেট Ca(NO3)2.4H2O | ১০০.০ |
৪ | ম্যাগনেসিয়াম সালফেট (MgSO4.7H2O) | ৫১.০ |
৫ | ইডিটিএ আয়রন (EDTA Iron) | ৮.০ |
৬ | ম্যাঙ্গানিজ সালফেট (MnSO4.4H2O) | ০.৬১ |
৭ | বরিক এসিড (H3BO3) | ০.১৮ |
৮ | কপার সালফেট (CuSO4.5H2O) | ০.০৪ |
৯ | অ্যামোনিয়াম মলিবটেড (NH4)6MO7O24.4H2O | ০.০৩৮ |
১০ | জিঙ্ক সালফেট (ZnSO4.7H2O) | ০.০৪৪ |
মিশ্রণ প্রক্রিয়ায় জলীয় খাদ্য দ্রবণ তৈরির সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রথমে Stock Solution তৈরি করতে হবে। এই Stock তৈরি করার সময় ক্যালসিয়াম নাইট্রেট এবং EDTA Iron কে পরিমাপ করে ১ লিটার পানিতে দ্রবীভূত করে দ্রবণকে Stock Solution “A” নামে নামকরন করতে হবে। অবশিষ্ট রাসায়নিক দ্রব্য গুলোকে পরিমাপ মত এক সাথে
১ লিটার পানিতে দ্রবীভূত করে Stock Solution “B” নামে নামকরণ করতে হবে। ১০০ লিটার জলীয় দ্রবণ তৈরির ক্ষেত্রে প্রথমে ১০০ লিটার পানি ট্যাঙ্কে নিতে হবে। তারপর Stock Solution “A” থেকে ১ লিটার দ্রবণ ট্যাংক এর পানিতে ঢালতে হবে,
এবং একটি অধাতব দণ্ডের সাহায্যে নাড়া চাড়া করে ভালো ভাবে মিশাতে হবে। এরপর Stock Solution “B” থেকে পূর্বের মত ১ লিটার ট্যাঙ্কে নিতে হবে এবং পূর্বের ন্যায় অধাতব দণ্ডের সাহায্যে পানিতেStock Solution গুলো সমানভাবে মিশাতে হবে।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ফসলের চারা রোপণের বয়স ও PH মাত্রা বিভিন্ন হয়ে থাকে। নিচে তা উল্লেখ করা হলো-
ফসলের নাম | উপযুক্ত চারার বয়স | PH মান |
টমেটো | ৩-৪ সপ্তাহ (২-৩ পাতা অবস্থায়) | ৫.৫-৬.৫ |
লেটুঁস | ২-৩ সপ্তাহ | ৬.০-৬.৫ |
ক্যাপসিকাম /মরিচ | ৪-৫ সপ্তাহ | ৬.০-৬.৫ |
স্ট্রবেরী | ২-৩ সপ্তাহ (স্টোলন কাটিং) | ৫.৫-৬.৫ |
শসা/খিরা | ২-৩ সপ্তাহ | ৫.৮-৬.০ |
বাঁধাকপি/ফুলকপি | ৪-৫ সপ্তাহ | ৬.৫-৭.৫ |
যদি PH এর মাত্রা কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে বেশি হয় তবে হাইড্রোক্লোরিক এসিড বা নাইট্রিক এসিড যোগ করে PH কমাতে হবে। আবার যদি দ্রবনের PH এর মাত্রা কমে যায় তবে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড বা পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইড যোগ করতে হবে।
সাফল্ভাবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনের জন্য নিম্নের বিষয়গুলির উপর বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে। বিষয়গুলি হলো-
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ এবং এখানে স্বাভাবিক চাষের জমি অপ্রতুল হওয়ায় বাড়ির আঙ্গিনায়, ঘরের ছাদে অথবা নেট হাউজে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সবজি ও ফলের চাষ করে একদিকে যেমন বিশাল জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব অন্যদিকে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব।