আজ শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৫ পূর্বাহ্ন

মাছ ধরার পর সংরক্ষণের সহজ পদ্ধতি

মাছ ধরার পর সংরক্ষণের সহজ পদ্ধতি

মাছ ধরার পর সংরক্ষণের সহজ পদ্ধতি

শীতলীকরণঃ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে স্বল্প সময়ের জন্য মাছের সজীবতা রক্ষার্থে শীতলীকরণ অত্যন্ত সুবিধাজনক ও বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে মাছের তাপমাত্রা হিমাংকের কাছাকাছি আনা হয়, তবে হিমাংকের নিচে নয়।
এ পদ্ধতি খুব দ্রুত ও দক্ষতার সাথে পরিচালনার মাধ্যমে খুব ভাল ফল পাওয়া যায়। তবে দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষণে শীতলীকরণ পদ্ধতি অনুপযোগী। আহরণের পর পরই যদি মাছকে অন্তর্বতীকালীন সংরক্ষণের প্রয়োজন হয় যেমন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রেরণ,
অবতরণ কেন্দ্র থেকে বাজারে বা প্রক্রিয়াজাত কারখানায় প্রেরণের প্রয়োজন হয় তবে এ পদ্ধতি অবলম্বনে ভাল ফল পাওয়া যায়।
শীতলীকরণের প্রধান লক্ষ্য হলো মাছের তাপমাত্রাকে ০-৫ সে. এর কাছাকাছি নিয়ে আসা। তাপমাত্রা কমানোর উপকারিতা হলো-
  • মাছের গুণাগুণ ভাল থাকে;
  • সকল রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ৩.৩০ সে. তাপমাত্রায় মারা যায়। সুতরাং কোনক্রমে তাপমাত্রা যদি ৩.৩০ সে. এর নিচে কমানো যায তাতে রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া মারা যাবে;
  • যদিও সাইক্রোফিলিক (Psychrophilic) ব্যাকটেরিয়া নিম্ন তাপমাত্রায় বাঁচে, কিন্তু তাদের ক্ষেত্রেও যত তাপমাত্রা কমানো হয়, ততই তাদের অসুবিধার সৃষ্টি হয়।
সুপার চিলিং: এটি এমন এক পদ্ধতি যেখানে মাছকে হিমাংকের বিন্দুর একটু নীচের তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয় এবং যে তাপমাত্রায় মাছের দেহ হিমায়িত হতে শুরু করে। মাছের গুণগতমান বিবেচনায় ২-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত মাছের সংরক্ষণ কাল বাড়ানো যায়।

মাছ ধরার পর সংরক্ষণের সহজ পদ্ধতি

শীতলীকরণের উপায়সমূহঃ

  • বরফ ব্যবহার করে;
  • মাছের উপর দিয়ে শীতল বায়ু প্রবাহ করে;
  • হিমায়িত সামুদ্রিক পানি ব্যবহার করে;
  • শুষ্ক বরফ (কঠিন কার্বন ডাই অক্সাইড) তরল নাইট্রোজেন শীতল এমোনিয়া ইত্যাদি ব্যবহার করে;
  • সংরক্ষক ও বরফ ব্যবহার করে।
বরফ ব্যবহারঃ নিম্ন তাপমাত্রায় র এ মাছ সংরক্ষণ কটি স্বল্পকালীন পদ্ধতি। স্বাদু পানি থেকে উৎপাদিত টুকরো বা গুড়ো বরফ (Flacked ice) ব্যবহার করে মাছকে আচ্ছাদিত করা হয়। ফলে মাছের পচন সাময়িকভারে রোধ করা যায়। কারণ-
  • সঠিকভাবে মাছের তাপ (০ সে. থেকে ৪ সে.) কমিয়ে আনার ফলে এনজাইম, জারণ ও ব্যাকটেরিয়াজনিত পরিবর্তন কমিয়ে দেয়;
  • বরফগলা পানি মাছের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং ব্যাকটেরিয়া, রক্ত, শে­ষ্মা ইত্যাদি ধৌত করে। বরফ ব্যবহার করে শীতলীকরণে বরফ ও মাছের অনুপাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দিনের তাপমাত্রা ও শীতলীকরণের উদ্দেশ্যের উপর নিভর্র করে বরফ ও মাছের অনুপাত নির্ণয় করা হয়। শীতকালে বরফঃ মাছের অনুপাত ১:২ এবং গ্রীষ্মকালে ১:১ ব্যবহার করা হয়।
  • মাছকে বরফ দ্বারা সংরক্ষণের জন্য এক ধরনের বাক্স ব্যবহার করা সুবিধাজনক। এ বাক্সকে ফিশ ক্রেট (Fish crate) বলা হয়।
বরফ ব্যবহারের সুবিধাঃ বরফ তাপমাত্রা কমিয়ে এনে মাছের পচন রোধ করে। এছাড়া বরফ ব্যবহারে যে সকল সুবিধা পাওয়া যায় তা হলো-
  • বরফ গলা পানি মাছের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং ব্যাকটেরিয়া রক্ত শে­মা ইত্যাদি ধৌত করে;
  • বরফ গলা পানি মাছের উপরিতলকে ভেজা রেখে শুকানো প্রতিরোধ করে এবং চকচকে ভাব সংরক্ষণ করে;
  • বরফ গলা পানি তাপ আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে;
  • ভাল পানি দ্বারা তৈরি বরফ বিষাক্ত নয় এবং নিরাপদ;
  • বরফ সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বহন করা যায়;
  • বরফ শূণ্য ডিগ্রী সেলসিয়সি তাপমাত্রায় গলে বলে এটি মাছকে হিমায়িত করে না তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাপমাত্রাকে আদর্শ শীতলীকরণ তাপমাত্রার কাছে থাকে;
  • বরফ তুলনামূলকভাবে সস্তা;
  • মাছকে যে কোন ধরনের ধারকে স্বল্প সময়ের জন্য সংরক্ষণ করা যায় যদি বক্স না থাকে;
  • মাছকে যে কোন জায়গায় যে কেহ যেমন-মৎস্যজীবী, পরিবহনকারী, আড়ৎদার, খুচরা বিক্রেতা এমনকি ভোক্তা পর্যন্ত বরফায়িত করতে পারে।
আরও পড়ুন   প্লান্ট বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশন

 

বিভিন্ন ধরনের বরফ শীতলকরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। ফ্লেক আইস সাধারনত দ্রুত তাপমাত্রা কমিয়ে আনার জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় ব্যবহার করা হয়।
আবার ব্লক আইস সাধারণত সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়। তবে ব্লক আইস ব্যবহারের ক্ষেত্রে যতদুর সম্ভব একৈ আকারে ছোট ছোট কৈায় ভেংগে ব্যবহার করা উচিত।

বরফ ব্যবহারের সুবিধাঃ

বরফ তৈরীর পানির প্রকৃতিঃ

  • বরফ তৈরিতে পরিস্কার এবং জীবাণুমুক্ত পানি ব্যবহার করা উচিত।
  • পৌরসভার সরবরাহকৃত পানি সরাসরি বরফ তৈরিতে ব্যবহার করা উচিত নয়। জীবাণুমুক্ত (পরিস্কারক/জীবাণুনাশক/ব্লিচিং) করে ব্যবহার করা উচিত;
  • পুকুর, গর্ত, লেক, নদী, খাল বা সমুদ্র উপকূলের পানি বরফ তৈরির কাজে ব্যবহার করা উচিত নয়। এসব প্রাকৃতিক পানিতে কাদা, ময়লা, পঁচা দ্রব্য, ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য জীবাণু থাকে। এ পানি ব্যবহার করে তৈরি বরফ মাছ সংরক্ষণে ব্যবহার করলে তা উৎস হিসাবে কাজ করে;
  • সামুদ্রিক পানিতে লবণ থাকে। যার ফলে সামুদ্রিক পানি বরফে পরিণত করতে সাধারণ পানির চেয়ে কম তাপমাত্রার অর্থাৎ শূণ্য ডিগ্রী সেলসিয়াস এর চেয়ে কম তাপমাত্রায় নিতে হয়। এজন্য সামুদ্রিক পানি থেকে তৈরি বরফ তৈরী করা হয় না। এছাড়া বরফ তৈরি করতে অনেক বেশী সময় ও বিদ্যুত প্রয়োজন হয়। তবে স্বাদুপানি অপ্রতুল হলে সামুদ্রিক পানি ব্যবহার করা যেতে পারে;
  • টিউবয়েল বা ডিপটিউবয়েলের পানি শোধণ করে বরফ তৈরির কাজে ব্যবহার করলে ভাল গুণগত মানের বরফ পাওয়া যায়;
  • বরফ তৈরির কারখানার পানির আধার নিয়মিত পরিস্কার করা উচিত;
  • এন্টিবায়োটিক যুক্ত পানি দিয়ে তৈরি বরফ ব্যবহার করে মাছ সংরক্ষণের মেয়াদকাল বৃদ্ধি করা যেতে পারে। তবে তা অবশ্যই অনুমোদিত বিধি বিধানের আলোকে ব্যবহার করতে হবে।

মাছ সংরক্ষণ ও পরিবহনের নতুন পদ্ধতিঃ

বাংলাদেশ কৃষি বিশববিদ্যালয়ের মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরনের প্রফেসর ড. নওশাদ আলম একটি কার্যকরী বরফ বাক্স উদ্ভাবন করেছেন। এটি সস্তা অথচ কার্যকরী বরফ বাক্স।
এতে মাছ পরিবহন কৌশলটিতে বহুল ব্যবহৃত বাঁশের ঝুড়ির উন্নয়ন ঘটিয়ে তাপ চলাচল প্রতিরোধী বরফ বাক্সে পরিণত করা হয়েছে।পরিবর্তিত ঝুড়িতে মাছ ঝুড়ির সংর্স্পশে আসে না।
তাই বাঁশের চটির ফাঁক ফোকর থেকে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকেনা। এমনকি পলিথিন দিয়ে আগাগোড়া মোড়া থাকে বলে বার বার পরিষ্কার করে একই ঝুড়ি ব্যবহারেও সমস্যা হয় না। ২৫ থেকে ৩০কেজি মাছ ধরে এমন একটি বাঁশের ঝুড়ির ভেতরের দিকটা হোগলা পাটি দিয়ে মুড়ে দিতে হয়।
হোগলার উপর দু’স্তর প্লাস্টিকের শিট দিয়ে সেলাই করে দিতে হয়। শিটের কিছু অংশ বাড়তি থাকবে। সেলাই করা প্লাস্টিকের শিটের উপর আর একটি পাতলা স্বচ্ছ পলিথিন শিট বিছিয়ে বরফ দেয়া মাছ পরিবহন করতে হবে।
প্রথমে পলিথিন শিটের উপর ১স্তর বরফ রেখে মাছ সাজিয়ে দিতে হয।এরপর ভাঁজে ভাঁজে বরফ ও মাছের স্তর সাজিয়ে ওপরে জাম বরফ দিয়ে বাড়তি চট, হোগলা ও পলিথিন শিট একসাথে মুড়ে ঝুড়ির ওপরে বেধে নিতে হয়।
ঝুড়ির মুখ সব সময় বেধে রেখে মাছ পরিবহন করতে হয়। এভাবে বরফ দেয়া মাছ ২৪ ঘন্টা পুনরায় বরফ না দিয়ে গুণাগুণ সঠিক রেখে সংরক্ষণ করা যায়।২৪ঘন্টা পর পর মাছের উপর সামান্য জাম বরফ দিয়ে প্রায় ৫-৬ দিন পর্যন্ত খুব ভালোভাবে মাছকে সংরক্ষণ করা যায়।
হোগলাপাতা, ছেড়াজাল, বা নাইলন কাপড় চমৎকার তাপ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।বরফ বাক্সটি মাঠ পর্যায়ে মৎস্যজীবি, মৎস্য ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র প্রক্রিয়াজাতকারী ও মৎস্য পরিবহনকারীদের দ্বারা সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
তারপরও যদি কোনো সমস্যা ও জানার থাকলে উপজেলা মৎস্য অফিস এবং ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ মাৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ ও দেশি পোনা সংগ্রহ করা যেতে পারে।

মাছ সংরক্ষণ ও পরিবহনের নতুন পদ্ধতিঃ

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে দিন

Comments are closed.

© All rights reserved © 2014 Ajkerkrishi.com
Developed By One Planet Web