শীতে মাছ ও পুকুরের পরিচর্যা

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

ঋতুর আবর্তনের রূপসী বাংলা। ছ’ঋতুর ছয় রকমের বৈশিষ্ট্য। শীতের সকাল কবি সাহিত্যিকদের জন্য আকর্ষনিয় হলেও জনস্বাস্থ্য ও প্রাণিকুলের জন্য কখনই সুখ বয়ে আনে না। শীতকাল আসলেই সাথে নিয়ে আসে জীবের জন্য মারাতœক মারাতœক সব রোগ। আর তাই আমাদের নিজেদের সুরক্ষার পাশাপাশি শিশু বৃদ্ধ সহ আমাদের অধিনে থাকা পশু-পাখিদের উপরো যেমন বাড়তি নজর রাখতে হয় ঠিক তেমনি মাছ ও মাছের ঘের এবং পুকুর গুলোর যতœ নেয়া উচিত। শীতের কুপ্রভাবেও বিশেষ যতœ ও পরিচর্যা করলে মাছের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যায়।

পৌষ-মাঘঃ সময়টা শীতকাল, মাছ চাষীদের ক্রান্তিকাল। পৌষ মাস থেকেই হালকা শীত পড়তে শুরু করে। এজন্য মাছের খাদ্য গ্রহণ অনেকটা কমে যায়। পুকুরে এ্যামোনিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। পানিতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয় এবং মাছের মৃত্যু ঘটে।

এই সময় পুকুরের বদ্ধ জলে মাছ চলাফেরা খুবই কম করে। ফলে মাছের খিদে কম পায়, রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। দিন ছোট হওয়ায় রোদ অল্প সময় পুকুরের জলে পড়ে। ফলে পুকুরের জলের ক্রমাগত পরিবর্তন শুরু হয়, এতে পুকুর ও মাছের যে

সমস্যাগুলো দেখা দেয়ঃ-

শীতকালে জলের তাপমাত্রা কমতে থাকে। সাধারণত তাপমাত্রা ২৮-৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হলে মাছের বিপাক ক্রিয়া ভাল হয়। এর কম হলে বিপাক ক্রিয়া কমে যাওয়ায় বৃদ্ধির হার কমে।

অক্সিজেন উৎপাদন কমে যাওয়ায় মাছের শ্বাসকার্য চালাতে কষ্ট হয়। মাছ জলের উপরের দিকে ভাসতে থাকে। মাছের মৃত্যুও ঘটে থাকে।

পুকুরের মধ্যস্থিত উদ্ভিদকণার প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় জলে দ্রবীভূত কার্বন ডাই অক্সাইডের (CO2) পরিমাণ বেড়ে যায়। এর ফলেও মাছের শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়।

ফাইটোপ্লাংটন বা উদ্ভিদকণা ও জুয়োপ্লাংটন বা প্রাণিকণা কমে যাওয়ায় মাছের খাবার স্বল্পতা দেখা দেয় ফলে দৈহিক বৃদ্ধি হ্রাস পায়।

জলের পিএইচ (PH) স্বাভাবিক থাকে না। মাছের বৃদ্ধির জন্য স্বাভাবিক পিএইচের মান ৬-৮ এর মধ্যে থাকা উচিত। যদি এর থেকে কম হয়, তাহলে জল অম্ল হবে এবং মাছ খাবার খেতে অনীহা দেখাবে। আবার বেশি হয়ে গেলে জল ক্ষারীয় হবে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে মডক দেখা দিতে পারে।

আরও পড়ুন   আমের ভালো ফলন পেতে যা করণীয়

৭) চলতি মৌসুমে মাছের বিশেষ কিছু কিছু রোগ দেখা যায়। এসময় সঠিকভাবে মাছের যতœ না নিলে মাছের ক্ষতরোগ, লেজ ও পাখনা পচা রোগ, ফুলকা পচা রোগ এবং উদর ফোলা রোগ এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে মাছ মরে যেতে পারে।

পরিচর্যা পদ্ধতিঃ

পুকুরে পাড় যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখতে হবে। যাতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ে।
কৃত্তিম উপায়ে পানিতে অক্সিজেনের বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। জাল টেনে, সাঁতার দিয়ে এবং বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে পানিতে অক্সিজেনের বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। এছাড়াও একরপ্রতি পাঁচ থেকে ১০ কেজি টিএসপি দিয়ে কাজ চালানো যেতে পারে। প্রতি ১০-১৫ দিন অন্তর পুকুরে জাল টানলে স্বাস্থ্য, মাছের সংখ্যা ও ওজন সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যাবে। এছাডা জাল টানার ফলে পুকুর থেকে বিভিন্ন ক্ষতিকারক গ্যাস বেরি যায়।

শেওলা, আবর্জনা, কচুরিপানা, আগাছাসহ সব ক্ষতিকর জলজ উদ্ভিদ পরিষ্কার করতে হবে।

পুকুর পাড়ে পাতাঝরা গাছ থাকলে, গাছের পাতা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
পুকুরের জলে পিএইচ ৬-৮ এর মধ্যে থাকলে, শীতের শুরুতে ১৫ থেকে ২০ দিন বা একমাস অন্তর অন্তর পুকুরে প্রতি শতাংশে এক কেজি ডলোচুন ও এক কেজি লবণ মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। পিএইচ কম থাকলে চুনের পরিমাণ বাড়াতে হবে। পিএইচ বেশি থাকলে চুন দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।

জৈব সার দিতে হবে। কিন্তু খেয়াল রাখবেন, জৈব সার পচনের জন্য প্রচুর অক্সিজেনের খরচ হয়। তাই মেঘলা দিনে বা সূর্যের আলো তেমন না পড়লে জৈব সার উচিত না।

পুকুরে উদ্ভিদকণা বৃদ্ধির জন্য অজৈব সার বিশেষ করে ইউরিয়া (বিঘা প্রতি মাসে ৪-৫ কেজি)ও সিঙ্গল সুপার ফসফেট (বিঘা প্রতি মাসে ৫-৬ কেজি) প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু পুকুরের জলের উপর থেকে দৃশ্যতা ২৫-৩০ সেমির কম হলে বা জল ঘন সবুজ রঙের হয়ে গেলে অজৈব সার দেওয়া চলবে না।

আরও পড়ুন   ছাঁদ কৃষি এবং কৃষি কাজে কোকো পিটের ব্যবহার

মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য চালের কুঁড়ো, ভূট্টার গুঁড়ো ইত্যাদির সঙ্গে সমপরিমাণে খোল যেমন, সর্যে, বাদাম, তিল ইত্যাদি মেশাতে হবে। মূল খাবারের সঙ্গে অতি অবশ্যই ১ খনিজ লবণ বা ২ সাধারণ লবণ মেশাতে হবে।

মাছের হজমশক্তি বাডানোর জন্য প্রতি কুইন্ট্যাল খাবারে ৫০-১০০ গ্রাম উপযুক্ত উৎসেচক বা এনজাইম বা হজমি প্রয়োগ করা উচিত। এতে মাছের খাবার চাহিদা বাড়বে।

শীতে সাধারণত পুকুরের পানি কমে যায়। আর কম থাকলে গোসাপ, উদবিড়ালরা মাছ খেয়ে ফেলতে পারে। এদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রয়োজনমত পানি সরবরাহ করতে হবে। মাছের ঘনত্ব স্বাভাবিক বা কম রাখতে হবে। পাতা ঝরা বৃক্ষের পাতা পড়ে বা হাট বাজারের পাশের কিংবা কলকারখানার ইত্যাদি কোন কারনে পুকুরের পানি বেশি দূষিত হলে পানি পরিবর্তন করতে হবে।

প্রয়োজনে স্ট্রেপটোসাইকিন (৫০ পিপিএম) জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক বা পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট (২০০-২৫০পিপিএম) জলে মিশিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

লেখকঃ কৃষিবিদ ডঃ মোঃ মুনিরুজ্জামান

ই-মেইলঃ munir.hstu@gmail.com

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now