মৌসুমের শুরুতে আম গাছের যত্নে করণীয়

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

মৌসুমের শুরুতে আম গাছের যত্নে করণীয়

মৌসুমের প্রথমে আম উদ্ভিদের যত্নে করণীয় কি তা আজকে আলোচনা করা হবে সবারই জানা কর্তব্য একারণে শেয়ার করে দিন ভিন্ন সব আম চাষীদের জন্য।

আম পরম সুস্বাদু এবং জনপ্রিয় রাষ্ট্রীয় ফল। পুষ্টি বিবেচনায় এ ফলের অবস্থান বেশ ওপরে। আমকে হয় ফলের রাজা। বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। জাতীয় ইনকামের প্রধান অংশই আসে কৃষি থেকে। কাজেই কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে সূদৃঢ় এবং সুসংহত করতে আমের অধিক ও সম্প্রসারণ অধিক উৎকর্ষ অপরিহার্য। নির্ভুল সময়ে আমগাছের পরিচর্যা, রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন করে অনেকাংশে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।

বাংলাদেশ কৃষি তত্ত্বানুসন্ধান ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের দ্বারা বিভিন্ন প্রযুক্তি যেমন- সার ও সেচ প্রয়োগ ব্যবস্থাপনা, রোগ ও পোকামাকড় নিবারণ প্রভৃতি উদ্ভাবন আমচাষিদের মধ্যে সাড়া জাগাতে উপযোগী হয়েছে। আগে আম চাষে তেমন কোনো বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা না হলেও অধুনা উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করার ফলে উৎপাদনও বেড়েছে। এখনো কিছু কিছু আমচাষি আম মৌসুমের ১ম হতে আম সুবিশাল হওয়া পর্যন্ত কোন কাজটি কোন টাইমে করতে হবে তা ঠিকভাবে না জানায় উদ্ভাবন ব্যাহত হয়। সুতরাং আমের বৃদ্ধির জন্য সবারই সচেষ্ট হওয়া অধিক উৎকর্ষ দরকার।


উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ

শুষ্ক, ঊষ্ণ এবং ভিজে সব অঞ্চলেই আম ছাড় বহু জন্মাতে পারে। তবে আমের জন্য সর্বাপেক্ষা সুন্দর শুষ্ক আবহাওয়া । কিন্তু পুষ্পায়নের টাইম ঠাণ্ডা আবহাওয়া দরকার। আবার অত্যন্ত বহু শীত হলেও চমৎকার না, তাহলে বাডগুলো সুপ্ত অবস্থায় থাকার ফলে মুকুল বের হয়ে যায় না। একটু পেলে মুকুল বের থেকে শুরু করে। ফল ধারণের সময় আবহাওয়া এবং ফলের বৃদ্ধি এবং পরিপক্বতার জন্য উষ্ণতা আবহাওয়া দরকার। আমগাছে মুকুল প্রবল বৃষ্টিপাত টাইম আসমান বেশ ক্লিয়ার থাকা ও কুয়াশা না হওয়া পরম বাঞ্ছনীয়। রিজন প্রবল বৃষ্টিপাত ও কুয়াশা আমের মুকুলের পক্ষে অনেক ক্ষতিকারক।

কিন্তু ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাস আম উৎপাদনের জন্য সুবিশাল সমস্যা। কারণ কয়েকটি ব্যতিক্রম ব্যতীত এই দুই মাসে আবহাওয়া অত্যন্ত একটা সুন্দর থাকে না। প্রায়ই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়। রোদ থাকে না বরং কুয়াশায় গগন ঢাকা থাকে। এতে স্ত্রী শোষক (হপার) পোকা ডিম পেড়ে অসংখ্য পোকার তৈরি করে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। এ পোকা ব্যতীতও মিলিবাগ ও স্কেল ইনসেক্ট মধুজাতীয় পদার্থ নিঃসরণ করে ফলে শুঁটিমোল্ড রোগ লক্ষ্য দেয়। এই রোগের ফলে গাছের পত্রের ওপর কালো আবরণ পড়ে। পর্যাপ্ত সময় শাখা এবং পরিপুষ্ট আমের গায়েও মরশুম ঢাকনা লক্ষ্য যায়। এ কালো আচ্ছাদন হচ্ছে ছত্রাকদেহ এবং বীজকণার সমষ্টি।

এ রোগ উদ্ভিদের খাদ্য উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায় এবং এতে আমের তরু অপটু হয়, আমের ফলন অনেকটা ছাড় হয়ে যায় ও মান কমে যায় যায়। এজন্য এ টাইম গাছের কান্ডে ও পাতায় সাইপারমেথ্রিন (রিপকর্ড/রেলথ্রিন/সাইথ্রিন ইত্যাদি) ১মিলি./লিটার কিংবা সেভিন ২ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশেয়ে স্প্রে করতে হবে। ও মুকুল বের হয়েছে অথচ কুসুম ফোঁটার আগে (পুষ্প মঞ্জরির দৈর্ঘ্য ৫-১০ সেমি. হলে) একই ও তার সাথে ছত্রাকনাশক ডায়থেন এম-৪৫, ২ গ্রাম/লিটার কিংবা টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

আরও পড়ুন   মিষ্টি গাছ স্টেভিয়া চাষ পদ্ধতি

তাছাড়া পাউডারি মিলডিউ যাতে মুকুল নষ্ট করতে না পারে তার জন্য এ মাসের শেষ সপ্তাহে একবার সালফার সংঘটিত ছত্রাকনাশক (থিওভিট ২ গ্রাম/ লিটার) স্প্রে করতে হবে। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম থেকে তাপ বৃদ্ধির সাথে সাথে আমের মুকুলের কুঁড়িগুলো বের হয়ে যায় ও প্রচুর সময় মেঘলা গগন ও কুয়াশা থাকার কারণে মুকুলে পাউডারি মিলডিউ রোগ লক্ষ্য দেয়। ফলে পরম দ্রুত মুকুলের গায়ে শ্বেত ধলা পাউডারের মতো নোটিশ দেয়। থিওভিট প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে করলে তা দমন করা যায়। অথবা সালফারের গুঁড়া বা দ্রবণ (০.২%) স্প্রে করলেও এই রোগের প্রকোপ কমে যায় যায়। তাছাড়া অ্যানথ্রাকনোজও এই টাইম নোটিশ দেয়।

ফলে সকল মুকুল কালো হয়ে ঝরে পড়ে। কাজেই ডায়থেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। বৃক্ষে বউ শোষক (হপার) পোকা নোটিশ গেলে সাইপারমেথ্রিন (রিপকর্ড/লেথ্রিন ইত্যাদি) ১ মি: লি:/ লিটার পক্ষান্তরে সেভিন ২ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা দরকার। তবে শোষক (হপার) পোকার সঙ্গে ছত্রাকজাতীয় রোগ দমনের জন্য কীটনাশকের সাথে ছত্রাকনাশক মিশিয়ে স্প্রে করলে আমের অনেক ভালো ফলন পাওয়া যায়। যদি এই মাসে ফলের গুটি মটর দানার মতো হয়ে যায় ও ফল বহু করে ঝরে পাঠ করলে তা রোধের ও আকার বৃদ্ধির জন্য প্ল্যানোফিক্স ২ মিলি ৪.৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে বৃক্ষে ভালোভাবে স্প্রে করা উচিত।

মার্চ মাস হতে শুরু করে এপ্রিল ও মে মাস পর্যন্ত অত্যন্ত খরা অর্থাৎ উচ্চ তাপমাত্রা (৩১.৫ সে: বা তার ঊর্ধ্ব), আর্দ্রতা (৮০-৮৫%) ও মাঝে মাঝে বৃষ্টি এবং মুল্যবান পুষ্টির অভাব থাকার কারণে প্রায় ছোট ও বিশাল সকল জাতের আমগাছ আগামরা ও আঠাঝরা রোগে আক্রান্ত হয়। যেহেতু মরা ডাল ও পত্রে রোগের জীবাণু থাকে কাজেই কানন ক্লিয়ার রাখতে হবে। যেহেতু পানির অনটনে অনেকাংশে এ রোগ হয়ে যায় একারণে এ সময় গাছে মুল্যবান সেচ দ্বারা পানির আভাব মুছে করতে হবে।

তাছাড়া প্রচুর টাইম এ মাসে ফল ধারণের পর থেকে ফল মটর স্ফটিকের দানা হওয়া পর্যন্ত শোষক (হপার) পোকা আক্রমণ করে থাকে। ফলে অতীতের মতো আবার ২য় বার শোষক (হপার) নিবারণ করতে হবে। তা সত্ত্বেও যদি কোন কারণে মুকুল দেরিতে অর্থাৎ ফাল্গুন মাসে আসে তবে এই ক্ষেত্রে ঔষধ ছিটানো প্রথমবার হওয়া উচিত। এমাসে আবহাওয়া বেশ শুষ্ক এবং হয়ে থাকে তাই কচি আমের আকার যখন মটর দানাদার সমান হবে সেই সময় ফলের পুষ্টি এবং বৃদ্ধির জন্য অন্তত একবার সেচ দেয়া প্রয়োজন।

আরও পড়ুন   তরমুজ চাষ পদ্ধতি

এমাসেই ফলন্ত তরু হতে নষ্ট ও বিকৃত পুষ্প মঞ্জরি ছাঁটাই করা প্রয়োজন। দেরিতে ফুল আসে এমন আম গাছে যদি অ্যানথ্রাকনোজ রোগের লক্ষণ লক্ষ্য যায় তবে ঠিক ছত্রাকনাশক স্প্রে করা প্রয়োজন। এ মাসে ফলের গুটি সন্তপর্ণে আস্তে বৃহৎ হয়ে যায়। আর এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে ফলপচা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। সুতারাং ডায়থেন এম-৪৫ প্রতিরোধক হিসেবে স্প্রে করা প্রয়োজন। সেচের ব্যবস্থা থাকে তাহলে বৃক্ষে পরবর্তী অকার বৃদ্ধি করতে এবং মান উন্নত করতে সুষম সার প্রয়োগ করা পরম প্রয়োজন।

এপ্রিল মাসের মধ্যে তাপমাত্রা আরও বাড়ে ও আর্দ্রতা কমে। ডাইব্যাক ও গামোসিসরোগের হাত থেকে ফলন্ত আম বৃক্ষকে (বিশেষ করে ২-১০ বছর) রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সেচ পানির দরকার। ফল-পচা রোগের আক্রমণ মুছে করতে ১৫ দিন পর পর দু’বার ছত্রাকনাশক যেমন- ডায়থেন এম -৪৫ ২ গ্রাম/রিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। কচি আমের ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ দমনের জন্য সুমিথিয়ন-৫০ ইসি ২ মিলি. হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছের ডাল-পালা ও আম পরিষ্কারভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।

যদি পাতায় রেড রাস্টের লক্ষণ দেখা দেয় তবে কপার-অক্সিক্লোরাইড (০.২%) বা বর্দো মিশ্রণ (১%) প্রতিষেধক ব্যবহার করতে হবে। মাটিতে ঝরে পড়ে থাকা আম কালেক্ট করে মাটিতে পুঁতে পেলা উচিত। এম মাসেই আম মার্বেল আকৃতির হয়ে যায় ও প্রচুর সময় বেশি করে ঝরে পড়তে থাকে। একারণে এই মাসে এবং প্ল্যানোফিক্স ২ মিলি ৪.৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালোভাবে বৃক্ষে স্প্রে করলে ফল ঝরা কমে যায় এবং ফলের আকার বৃদ্ধি পায়।

মে মাসে এবং পাতায় রেড রাস্টের হাবভাব যদি দেখা যায় তবে কপার-অক্সিক্লোরাইড (০.২%) বা বর্দো মিশ্রণ (১%) ছিটাতে হবে। এই মাসে আগাম বংশের আমে ফ্রুট ফ্লাই লাগতে পারে। কাজেই বিষটোপ/ব্লিচিং পাউডার ইউজ করতে হবে। আগাম জাতের কিছু কিছু আম এই মাসেই পাকতে শুরু করে। ঝরে পড়া পাকা আম কালেক্ট করে মাটির নিম্নদেশে পুঁতে পেলতে হবে। পাখি ও বাদুর পাকা আম বিকৃত করে। একারণে এদের প্রতি সর্তক দৃষ্টি রাখার জন্য হবে। তাছাড়া ফল-পচা রোগ মুছে করতেও এ মাসে অন্তত একবার ডায়থেন এম-৪৫ স্প্রে করা উচিত। আমের আগাম বংশ রয়েছে। এই মাসে সেগুলো পাকতে আরাম্ভ করে। আম কালেক্টের পর গরম পানিতে (৫৫ সে. তাপমাত্রা) ৫ মিনিট ডুবিয়ে অতঃপর শুকিয়ে গুদামজাত করা প্রয়োজন কিংবা ব্যাভিস্টিন দ্রবণে (১ গ্রাম/লিটার) ডুবিয়ে পরে শুকিয়ে রাখা উচিত।

আরও পড়ুন   কফি চাষ পদ্ধতি

জুন মাসের মধ্যে প্রায় প্রতিদিন বৃষ্টি হয়। তাই বৃক্ষের চমৎকার বৃদ্ধি হওয়ায় আমের পত্র কর্তন করা উইভিল নব পাতা কেটে দ্বারা উদ্ভিদের সাংঘাতিক ক্ষতি করে। কাজেই সেভিন ২ গ্রাম/লিটার পানিতে দ্বারা স্প্রে করা উচিত। বেশির অংশ আম এ মাসের মধ্যেই পাকে। আম কালেক্টের পর রোগের হাত হতে আমকে রক্ষার জন্য পানিতে (৫৫ সে. ৫ মিনিট) ডুবিয়ে পক্ষান্তরে ব্যাভিস্টিন দ্রবণে (১ গ্রাম/লিটার পানিতে) ডুবিয়ে শুকানো উচিত। এ মাসেও ফ্রুট ফ্লাই ও রেড রাস্টের আক্রমণ হতে পারে। এইজন্য মে মাসের ব্যবহৃত প্রতিষেধক ইউজ করতে হবে। বৃক্ষ হতে আম পাড়ার পর পরই যদি সুযোগ থাকে কিন্তু উদ্ভিদের মরা ডালপালা প্রুনিং করা কর্তব্য এবং জমিতে ‘জো’ থাকে তাহলে মুল্যবান সার দেয়া উচিত। এই মাসের মধ্যে বৃষ্টির কারণে পরিপুষ্ট আমের গায়ে কালো আঁচড় হয়। কাজেই এ টাইম ছত্রাকনাশক স্প্রে করা দরকার।

যেসব আম দেরিতে পাকে সেগুলোকে নাবি জাতের আম বলে এবং নাবি গোত্রের আম জুলাই মাসে পাকে। প্রধারনত জুন মাসের চেয়ে জুলাই মাসের মধ্যে বৃষ্টিপাত বহু হয়। ফলে ছত্রাক রোগে ফল আক্রান্ত হয়ে বেশি হিসাবে পচে বিকৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কাজেই মাসের ১ম সপ্তাহে আমগাছে ডায়থেন এম-৪৫, ২ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা উচিত। যদি পল্লবে রেড রাস্ট থাকে কিন্তু রোগের লক্ষণ দেখে প্রতি ১৫ দিন পর পর কপার অক্সিক্লোরাইড (০.২%), কুপ্রাভিট (০.২%) বা বর্দোমিশ্রণ (১%) স্প্রে করলে তা দমন হয়ে যাবে।

অতিরিক্ত বর্ষার কারণে যদি জুন মাসে বৃক্ষে সার ব্যবহার করা না হয়ে থাকে কিন্তু আম পাড়ার পর এ মাসেও সার দেয়া যাবে। আপেক্ষিক আর্দ্রতা কোনো স্থানের বৃষ্টিপাতের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সারা দেশে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে অধিকতর আর্দ্রতা বিরাজ করে। আম পাকার সময় আর্দ্রতা বেশি থাকে তাহলে ফ্রুট+ফ্লাইয়ের জুলুম বেড়ে যায়। কাজেই এ টাইম আমগাছে ফ্রুট ফ্লাই বা ফলের মাছি পোকা দেখা যায়।

আম মাছি পোকা দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পচে উদ্ভিদ থেকে মাটিতে পড়ে যায়। মাটিতে পড়া আম কালেক্ট করে বন্ধুর খুঁড়ে পুঁতে ফেলা উচিত। তাছাড়া মাছি পোকা দমনের জন্য বিষটোপ ইউজ করা অথবা ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়েও দমন করা যায়। আর যদি গায়ে কালো আঁচড় নোটিশ দেয় কিন্তু জুন মাসের ব্যবহারকৃত ইউজ করতে হবে। ।

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now