আজ বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪২ অপরাহ্ন
ট্যাংকে ঝিনুক থেকে মুক্তা চাষ করে আয় মাসে তিন লক্ষ টাকা শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। সবাই মনোযোগ দিয়ে পুরো আর্টিকেল টি পড়ুন এবং শেয়ার করে দিন উদ্যোক্তাদের মাঝে।
যদি মুক্ত চাও তবে সমুদ্রে যাও। সত্যিই কি সমুদ্রে মুক্ত মেলে? কদাচ মিলতেও পারে। তবে আপনার বাড়ির উঠোনেই যদি বালতি বালতি মুক্তা তৈরি হয় তাহলে কেমন হবে বলুন তো? ‘মুক্ত’ বা ‘পার্লস’ ক্ষুদ্রাকার উজ্জ্বল এই মোহনীয় বস্তুটির দেখা সাধারণত সমুদ্রের অয়েস্টারেই মেলে। তবে মানুষের সেই আদিম ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন কেরলের একজন কৃষক।
নিজের বাড়িতে পুকুর তৈরি করে তার স্বচ্ছ জলে উৎপাদন করছেন বালতি বালতি মুক্ত। শুধু তাই নয়, তাঁর উৎপাদিত মুক্ত বিদেশে রফতানি করে উপার্জনও করছেন লক্ষাধিক টাকা। শুনতে অবাক লাগলেও এমন অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছেন কেরলের কাসারগেদ অঞ্চলের বাসিন্দা কে.জে.মাথাচান।
আমরা সকলেই জানি,ঝিনুক থেকেই মুক্ত তৈরি হয়। আর এই ঝিনুক হল ‘মলাস্কা’ পর্বের অন্তর্গত এক ধরনের প্রাণী। এছাড়াও এদের দুটি খোলস থাকার কারনে ঝিনুককে বাইভাল্ভ শ্রেণীর অন্তর্গত বলেও গণ্য করা হয়। তবে মুক্ত উৎপাদনকারী ঝিনুককে ‘পার্ল অয়েস্টার’ বলা হয়। তাছাড়াও অন্যান্য কিছু মলাস্কা গোত্রীয়র ঝিনুক থেকেও মুক্ত তৈরি হয়।
তবে কে.জি মাথাচানের মতো এমন ভাবে মুক্ত ফলানোর প্রথম শর্তই হচ্ছে, পুকুরের জল হতে হবে একদম পরিষ্কার এবং নির্মল। কী ভাবে তিনি এই অসাধ্যসাধন করলেন? আর কেমন করেই এমনতর চিন্তাভাবনার উদয় হল? তাহলে আসুন বিশদে জেনে নেওয়া যাক। জানা গিয়েছে, কে.জে. মাথাচান সৌদি আরবের কিং ফাহদ বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিকমিউনিকেশনস ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ছিলেন।
সেই সময় হঠাৎ একদিন চিনের ‘আরামকো অয়েল কোম্পানিতে’ ইংরেজি থেকে আরবিক অনুবাদকের কাজ করার সুযোগ আসে তাঁর কাছে। কিছু দিনের জন্য চিনে যান তিনি। এই বিষয়ে তিনি বলেন, “চিনের উক্সিতে ধানসুই ফিসারিজ রিসার্চ সেন্টারে একদিন যাই। এই মাছ নিয়ে আমার চিরকালই একটা নেশা ছিল এবং আছে। আর সেখানে গিয়েই জানতে পারি যে, শুধু মাছ নয়।
পুকুরে কী ভাবে মুক্ত ফলানো যায়, সে কোর্সও শেখায় ওই ফিসারিজ রিসার্চ সেন্টার। ভারতে খুব কম সংখ্যক মানুষই রয়েছেন, যাঁরা এই ধরনের রিসার্চের কথা শুনে থাকবেন। আমি দেখলাম, এই কোর্স করলে আমার জীবন বদলে যেতে পারে।” এর কিছুদিন পরই সৌদি আরব থেকে চাকরি ছেড়ে চিনে ওই রিসার্চ সেন্টারে ডিপ্লোমা কোর্স করতে চলে আসেন কে. জে। ছয় মাস পরে কোর্স শেষ হতেই ঘরের ছেলে ফিরে আসে ঘরে। সেই ১৯৯৯ সাল থেকেই নিজের একটি পুকুরে শুরু করে দিলেন মুক্তর চাষ।
কে.জে মাথাচান আরও বলেন, “খুব দ্রুতই আমি সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছিলাম। বহু লোকই সেই সময়ে আমাকে এই কাজে নামতে বাধা দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, এই ধরনের চাষের কাজে সাফল্য আসবেই।” শুধু তাই নয়, যেমন ভাবা তেমন কাজ। এরপর তিনি সুদূর মহারাষ্ট্র থেকে পরিষ্কার জল নিয়ে এসে বালতিতে করে সাজিয়ে সেগুলি তারপরে পুকুরে ফেলে টেস্টিং শুরু করে দিলেন। এই ভাবে ঠিক ১৮ মাস রিসার্চ করার পরই ৫০ বালতি মুক্ত ফলিয়ে ফেলেন মাথাচান।
তিনি বলেন, “একদম প্রথম-প্রথমই আমি ১.৫ লক্ষ টাকা মুক্তোর চাষের কাজের জন্য খরচ করেছিলাম। আর সেখানে থেকে ৪.৫ লক্ষ টাকা উপার্জন করি আমি। অর্থাৎ প্রথমেই প্রায় ৩ লক্ষ টাকার লাভ, যে অঙ্কটা আমিও কখনও কল্পনা করিনি।” কিন্তু অয়েস্টার ব্যতিরেকে, কী ভাবে এই অসাধ্যসাধন সম্ভব? মাথাচানের ব্যখ্যায়, “মূলত তিন ধরনের মুক্ত রয়েছে- প্রাকৃতিক, কৃত্রিম এবং কর্ষিত।
কর্ষিত মুক্তই হচ্ছে আমি যেগুলি বিগত ২১ বছর ধরে আমার পুকুরে ফলাচ্ছি। সাধারণত পরিষ্কার জলেই চাষ সম্ভব এই ধরনের মুক্তের।” দেশে প্রস্তুত হওয়া এই ধরনের মুক্তের চাহিদা কী ভাবে বাড়ছে অস্ট্রেলিয়া, কুয়েত, আরব বা স্যুইৎজারল্যান্ডের মতো দেশে? মাথাচান বলেন, “ভারতের বাজারে মূলত যে মুক্তগুলি পাওয়া যায়, সেগুলি সাধারণত কৃত্রিম হয়।
তারা আসল দেখতে হলেও তাদের মধ্যে থাকে সিন্থেটিক। আর সেই কারণেই ভারতে এগুলি এতটা পরিমাণে সস্তা। সত্যিকারের মুক্তের ১ ক্যারেটের দাম ৩৬০ টাকা এবং তা ১ গ্রামের দাম প্রায় ১৮০০ টাকার কাছাকাছি।” প্রোডাকশন আরও একটু বেশি করে করার জন্য নিজের জমিতেই একটি কৃত্রিম ট্যাঙ্ক বসিয়েছেন মাথাচান।
লিবিন কুরিয়ান নামের এক ইউটিউবার সম্প্রতি ঘুরে এসেছেন মাথাচানের ওই মুক্তর কারখানা থেকে। তিনি বলছেন, “ওই ট্যাঙ্কটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ মিটারের কাছাকাছি, চওড়ায় ১৫ মিটার এবং গভীরতা ৬ মিটারের একটু বেশি। এই ধরনের ব্যবসায়িক বুদ্ধি আমি কখনও দেখিনি। সত্যিই অসাধারণ বুদ্ধি লোকটার। শুধু মুক্তই নয়। জমিতে নারকেল থেকে শুরু করে ভ্যানিলা, স্থানীয় নানাজাতের আমও ফলাচ্ছেন মাথাচান।”
২০১৮ সালে স্ট্রোক হয়েছিল কে. জি মাথাচানের। আর সেই থেকেই শারীরিক দুর্বলতা বাড়ায়, স্থানীয় বেশ কিছু কৃষককে এই মুক্ত ফলানোর বিষয়টি শিখিয়ে দিয়েছেন তিনি। এখন মাথাচানের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরাও সেখানে মুক্ত ফলান। শুধু তাই নয়, এখন এই নতুন ধরনের কৃষিকাজের জন্য ক্লাস নেওয়াও শুরু করে দিয়েছেন কে. জি মাথাচান।
দিনে দিনে তাঁর প্রভাব বাড়ছে গোটা কেরালা জুড়েই। আর তাতেই বহু মানুষ কেজি বাবুর কাছ থেকে মুক্ত কী ভাবে ফলানো যায়, তা-ই শিখতে চাইছেন। তবে লকডাউনের কারণে বিগত কিছু মাসে কঠিন ভরাডুবি দেখা দিয়েছে মাথাচানের ব্যবসায়। এখন অনলাইনেই কী ভাবে বিদেশে মুক্ত রফতানি করা যায়, তারই খোঁজে রয়েছেন তিনি।
এখন অনেকেই মাথাচানের ক্লাস করছেন স্রেফ একটা বিশ্বাস থেকেই। বাড়ির উঠোনেও যে মুক্তর চাষ সম্ভব কোনও দিন কল্পনাতেও ভাবেননি ওঁরা। কোচির এক গৃহবধূ আশা জন বলেন, “প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি। আর এখন যখন স্যারের ফার্মে ক্লাসের জন্য যাই, স্যারের পরামর্শ শুনি তখন মনে হয়, এই দুনিয়ায় সবই সম্ভব। আর্দ্রা সাহাদেভা নামের এক তৃতীয় বর্ষের বি.কম ছাত্রীও একই মতামত ব্যক্ত করেছেন।”