মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫, ১০:৪৭ অপরাহ্ন

গ্রীষ্মকালীন বারি মরিচ ২ এর চাষাবাদ

  • লাস্ট আপডেট : বুধবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৭
  • ১৯৩ টাইম ভিউ
WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

গ্রীষ্মকালীন বারি মরিচ ২ এর চাষাবাদ

মরিচ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী মসলা ফসল। কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থাতেই এ ফসলে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। রান্নার রং, রুচি ও স্বাদে ভিন্নতা আনার জন্য মরিচ একটি অপরিহার্য উপাদান। পুষ্টির পাশাপাশি মরিচের ভেষজ গুণ রয়েছে। কাঁচা মরিচ ভিটামিন-এ ও সি সমৃদ্ধ। প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা মরিচে ২-৩ গ্রাম আমিষ, ৬ গ্রাম শ্বেতসার, ০.৬ গ্রাম তেল, ৭ গ্রাম আঁশ, ১০০-থেকে ২০০০ আই.ইউ ভিটামিন-সি এবং ২০ থেকে ২৮ গ্রাম অন্যান্য ভিটামিন ও পানি রয়েছে। এটি ক্ষুধা বর্ধক, বায়ু নাশক ইত্যাদি গুণাবলি সম্পন্ন। বাংলাদেশে প্রায় ১৬ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে ৩৭ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন কাঁচা মরিচ উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কাঁচা মরিচ রপ্তানি হয়। রবিও খরিপ-১ মৌসুমে মরিচ সহজলভ্য হলেও খরিপ-২ মৌসুমে বাজারে স্বল্পতা দেখা দেয়। তাই বর্ষ ও শীত মৌসুমের পূর্বে মরিচের উৎপাদন অব্যাহত রাখার প্রয়াসে মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীগণের নিরলস প্রচেষ্টায় বারি মরিচ -২ নামে একটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয় এবং জাতীয় বীজবোর্ড কর্তৃক ২০১৩ সালে মুক্তায়িত করা হয়। জাতটি দেশে কাঁচা মরিচের মোট উৎপাদন বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।

জাতের বৈশিষ্ট্য: এটি একটি গ্রীষ্মকালীন মরিচের জাত। গাছ বেশ লম্বা ও ঝোপালো। গাছের পাতার রং হালকা সবুজ। প্রতি গাছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টি মরিচ ধরে। এই জাতের মরিচের ত্বক পুরু। কাঁচা অবস্থায় মরিচের রং হালকা সবুজ এবং পাকা অবস্থায় লাল। এ জাতের মরিচের জীবন কাল প্রায় ২৪০ দিন।

মাটি: উঁচু এবং মাঝারি উঁচু জমিতে এ জাতটি চাষ করা যায়। সুনিষ্কশিত , উর্বরতা সমৃদ্ধ বেলে দোঁআশ এবং পলি দোঁআশ মাটি এ জাতের মরিচ চাষের জন্য উত্তম। বাংলাদেশের বগুড়া, পাবনা, লালমরিহাট, ময়মনসিংহ ও সমগ্র খুলনা অঞ্চল, মানিকগঞ্জ ঢাকা প্রভৃতি এলকায় জাতটি চাষ করা যায়।

রোপণমৌসুম: এটি একটি গ্রীষ্মকালীন জাতের মরিচ। এপ্রিল মাসে জমিতে এ মরিচের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এ জাতের মরিচের চারা জমিতে রোপণ করা যায়।

চারা উৎপাদন: অপেক্ষাকৃত উঁচু যেখানে বৃষ্টির পানি দাঁড়ায় না, যতেষ্ট আলো-বাতাস পায়, পানি সেচের উৎস আছে এরূপ জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হবে।গ্রীষ্মকালীন মরিচের জন্য মার্চ মাসে বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে। প্রতিটি বীজতলার আকৃতি ৩ মি.ঢ ১ মিটার হওয়া উচিত। এ ধরনের প্রতিটি বীজতলায় ১৫ গ্রাম হারে বীজ সারিতে বপন করতে হবে। ভাল চারার জন্য প্রথমে বীজতলার মাটিতে প্রয়োজনীয় কম্পোষ্ট সার এবং কাঠের ছাই মিশিয়ে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। বীজ বপনের ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা আগে প্রতিকেজি বীজে ২ গ্রাম হারে প্রোভেক্স বা ব্যাভিষ্টিন মিশিয়ে শোধন করে নিতে হবে। শোধিত বীজ বীজতলায় ৪ থেকে ৫ সে.মি. দূরে দূরে সারি করে ১ সে.মি. গভীরে সরু দাগ টেনে ঘন করে বপন করতে হবে। বীজ বপনের পর বীজতলায় যাতে পোকামাকড় দ্বারা চারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য প্রতিলিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে সেভিন পাউডার মিশিয়ে মাটিতে স্প্রে করতে হবে। অতিবৃষ্টি বা খরা থেকে চারা রক্ষার জন্য বাঁশের চাটাই, পলিথিন বা নেট দিয়ে বীজতলা ঢেকে দিতে হবে। বাঁশের চাটাই বা পলিথিন সকাল বিকাল বা রাতে সরিয়ে নিতে হবে। নেট ব্যবহারে বিভিন্ন শোষক পোকা চারাকে আক্রমণ করতে পারে না এবং নেটের উপর দিয়ে হালকা সেচ দিলে চারা ভাল থাকে। ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে বীজ গজায়। চরা ৩ থেকে ৪ সে.মি. হলে নির্দিষ্ট দূরত্বে চারা পাতলা করা হয়। খাট, মোটা কান্ড ও ৪ থেকে ৫ পাতা বিশিষ্ট ৩০ থেকে ৩৫ দিন বয়সের উৎকৃষ্ট চারা মূল জমিতে রোপণ করারর উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়।
জমি প্রস্তুত ও বেড তৈরী: গ্রীষ্মকালীন মরিচ চাষের জন্য ৪ থেকে ৫টি আড়আড়িভাবে চাষও মই দিয়ে গভীরভাবে চাষ করে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। জমি থেকে আগাছা ও পূর্ববর্তী ফসলের আবর্জনা ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে। চারা রোপণের জন্য ১.২ মি. প্রস্থ বিশিষ্ট প্রয়োজন মতো লম্বা ৩০ সে.মি. উচ্চতার বেড তৈরী করতে হবে। পানি সেচ ও নিষ্কাশনের জন্য দুই বেডের মাঝখানে ৪০ থেকে ৫০ সে.মি. প্রশস্ত নালা রাখতে হবে।
বীজের পরিমাণ ও রোপণ দূরত্ব: বারি মরিচ-২ এর চারা তৈরী করার জন্য একর প্রতি ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব দিতে হবে ৬০ সে.মি. এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব দিতে হবে ৫০ সে.মি.। এ ভাবে রোপণ করলে একর প্রতি ১৩ ,৩৩৩ টি গাছ পাওয়া যায়।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি। মাটির প্রকৃতি, উর্বরতা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে সারের মাত্রা ভিন্ন হতে পারে। বারি মরিচ-২ এর জন্য একর প্রতি ২ টন কম্পোষ্ট, ৮৪ কেজি ইউরিয়া,১৩২ কেজি টিএসপি, ৮০ কেজি এমওপি ৪৪ কেজি জিপসাম ৬০০ গ্রাম বোরন সারের প্রয়োজন হয়। শেষ চাষের সময় কম্পোষ্ট, টিএসপি, জিপসাম, বোরন ও ১/৪ অংশ এমপি সার মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। তারপর চারা রোপণের ২৫, ৫০ ও ৭০ দিন পর পর্যাক্রমে ১ম ২য় ও ৩য় কিস্তিতে প্রতিবার ৭০ কেজি ইউরিয়া ও ৫০ কেজি এমওপি সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ প্রয়োগ: চারা রোপণ করার পর অবস্থা বুঝে হালকা সেচ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে চারা সতেজ থাকে এবং মাটিতে সহজে খাপ খাওয়াতে পারে। যেহেতু বারি-২ মরিচ খরিপ-২ মৌসুমে চাষ করা হয়, তাই অন্যান্য মরিচের মতো বেশি সেচ প্রয়োজন হয় না। তবে অবস্থা ভেদে ৩ থেকে ৪ টি সেচ প্রয়োজন হতে পারে।

আরও পড়ুন  বাড়ির ছাদে বারমাসী আমড়া চাষ

আগাছ দমন: ভাল ফলনের জন্য চারা রোপণের ১৫, ৩০ , ৪৫ও ৬০ দিন পর পর চার বার নিড়ানী দিয়ে আগাছা দমন করতে হবে।

মাটি তোলা: ভাল ফসলের জন্য ৩ থেকে৪ বার দুই সারির মাঝের মাটি তুলে দিতে হবে। এতে গাছের গোড়া শক্ত হয় এবং পানি নিষ্কাশনের সুবিধা হয়।

খুঁটি প্রদান: অধিক উচ্চতা, ফলনের ভার , ঝড়-বাতাস বা অতিবৃষ্টির কারণে গাছ হেলে পড়ে। ফলে মরিচের গুণাগুণ হ্রাস পায়। তাই হেলে পড়া থেকে রক্ষার জন্য খুঁটির সাথে মরিচ গাছ বেঁধে দিতে হবে।

ফসল ও বীজ সংগ্রহ: চারা রোপণের ৭০ থেকে ৮০ দিন পর মরিচ ফল উত্তোলন করা হয়। বারি মরিচ-২ এর জীবনকাল দীর্ঘ হওয়াতে প্রায় ৮ থেকে ১০ বার ফসল উত্তোলন করা যায়। উত্তম বীজের জন্য বড়, পুষ্ট ও সম্পূর্ণ পাকা মরিচ নির্বাচন করতে হবে। বর্ষাকালে মরিচ শুকানো বেশ কষ্টকর। এজন্য পাকা মরিচ দুই ফালি করে কেটে বীজ বের করে নিয়ে শুকাতে হবে।

বীজ সংরক্ষণ: মরিচের বীজ বিভিন্ন ধরনের বায়ুরোধী পাত্র, পলিথিন বা অ্যালুমনিয়াম ফয়েল প্যাকেটে সংরক্ষণ করা যায়। বীজ শোধনের জন্য অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির বায়ুরোধী পাত্র বা পলিথিন প্যাকেট ইত্যাদি ব্যবহার করা উচিত।

রোগ ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা: বারি মরিচ-২ জাতে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ নেই বললেই চলে। তবে মাঝে মধ্যে আগা মরা রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে। এ ছাড়া বীজের জন্য রাখা পাকা মরিচে ফল পচা রোগ দেখা দিতে পারে।

আগা মরা রোগ: সারা বছর এই রোগ হয়ে তাকে। তবে সাধারণত বৃষ্টি হওয়ার পর তাপমাত্রাও আর্দ্রতা বৃদ্ধি পেলে এ রোগের আক্রমণ বৃদ্ধি পায়।

রোগের লক্ষণ:

১। এই ছত্রাকের আক্রমণে নতুন আগায় ক্ষত দেখা দেয়।ফলে আগা মরতে মরতে পিছনের দিকে অগ্রসর হয়। এজন্যই এই রোগকে আগা মরা রোগ বলা হয়।

আরও পড়ুন  টবে বা ছাদ বাগানে জামরুল চাষ

২। গাছে যখন ফুল ধরা শুরু করে তখনই এই রোগের আক্রমণ দেখা দেয়। আক্রান্ত গাছের ফুল শুকিয়ে যায়।

৩। রোগ ফুল থেকে কা-ে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে এটি শাখা-প্রশাখা ও কা-ে ডাইব্যাক রোগের সৃষ্টি করে। শাখা- প্রশাখাগুলি নেতিয়ে শুকিয়ে যায়।

৪। মরা আগা পানি ভেজা বাদামি রং এর হয়ে থাকে ও চূরান্ত পর্যায়ে ধূসর সাদা বা খড়ের রং এর মতো ধারণ করে। আক্রান্ত আগা, কা- বা মরিচের ফলে অত্যধিক পরিমাণে কালো রং এর ছোট ছোট ছত্রাকের অণুবীজ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, যা খালি চোখে দেখা যায় না।

দমন ব্যবস্থাপনা:

১। রোগ মুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে।

২। বীজ বপনের পূর্বে প্রোভেক্স-২০০ প্রতি কেজি বীজের সাথে ২ গ্রাম বা কার্বেনডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক এক গ্রাম হারে মিশিয়ে শোধন করে কিছুক্ষণ ছায়ায় রাখার পর বপন করতে হবে।

৩। রোগের লক্ষণ দেখাদিলে প্রতি লিটার পানির সাথে ৩ গ্রাম হারে কুপ্রাভিট মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার সমস্ত গাছে স্প্রে করতে হবে।

ফল পচা রোগ: এটি একটি বীজবাহিত রোগ। এ রোগের কারণে মরিচের ফলন শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে।

রোগের লক্ষণ:

১।এই রোগের জীবাণু সাধারণত পাকা মরিচকে আক্রমণ করে থাকে।

২। আক্রান্ত ফলের ত্বকের উপর ছোট ছোট কালো গোলাকার স্পষ্ট দাগ দেখতে পাওয়া যায়।

৩। ফলের বিবর্ণ এলাকায় কালো ছত্রাকের অণুবীজ দেখতে পাওয়া যায়।

৪। আক্রমণের চূরান্ত পর্যায়ে ছত্রাক দ্বারা বীজ ঢেকে যায়।

৫। ফলে আক্রান্ত অংশ কালো হয়ে কুঁচকে যায়। আক্রান্ত ফল শুকিয়ে যায়।

দমন ব্যবস্থাপনা:

১। রোগমুক্ত গাছ হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।

২। রোগাক্রান্ত শুকনা কা- কেটে আগুনে পুড়য়ে ফেলতে হবে।

৩। ফসলের ক্ষেত সব সময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।

আরও পড়ুন  ছাদে বেগুনের চাষ পদ্ধতি

৪। রোগের লক্ষণ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানির সাথে ৩ গ্রাম হারে কুপ্রাভিট মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পর পর ৩ থেকে ৪ বার স্প্রে করতে হবে।

ফলন: ভালভাবে যত্ন নিলে বারি-২ জাতের মরিচে একর প্রতি ৮ থেকে ১০ টন ফলন পাওয়া যেতে পারে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে দিন

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
একই রকম পোস্ট