আজ সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১২ পূর্বাহ্ন

ভূমিহীনদের পথের দিশা তিস্তাচরের মিষ্টি কুমড়া

ভূমিহীনদের পথের দিশা তিস্তাচরের মিষ্টি কুমড়া

ভূমিহীনদের পথের দিশা তিস্তাচরের মিষ্টি কুমড়া

দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল কিছুই না হওয়ার চেয়ে অন্তত কিছু হোক। গবেষণার ভিত্তিতে কৃষি উৎপাদন ও ভূমিহীন কৃষকদের জীবনমানের উন্নয়নকে সামনে রেখে কাজ শুরু। আর শুরুর বছরেই অনাবাদি ও পড়ে থাকা বালুচরে পিট পদ্ধতিতে মিষ্টি কুমড়া চাষে মেলে সফলতা। এরপর কেবল সামনের দিকে এগিয়ে চলার গল্প।

চাষির সংখ্যা বেড়ে শত শত থেকে এখন হাজার হাজারে দাঁড়িয়েছে। মিষ্টি কুমড়ায় ভূমিহীন এসব চাষির সংসারে ফিরেছে স্বচ্ছলতা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন এর উদ্যোগ ও সহায়তায় বালুচরে মিষ্টি কুমড়া চাষের এ সফলতার দৃষ্টান্ত এখন সারা দেশজুড়ে। ২০০৫ সালে গাইবান্ধা জেলার চরাঞ্চলের ১১টি স্থানে ১৭৭ জন চাষিকে নিয়ে সবজি ফলানোর এ সংগ্রাম শুরু করে প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন। এর পরের কয়েক বছরের মধ্যেই রংপুর জেলার তিস্তা নদীর বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে মিষ্টি কুমড়া চাষে বিপ্লব ঘটে গেছে।

রংপুরের কাউনিয়া ও গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা নদীর জেগে ওঠা বালুচরে উত্তোলনের অপেক্ষায় পড়ে থাকা সারি সারি মিষ্টি কুমড়ার নান্দনিক শোভায় মুগ্ধ কৃষক, থমকে দাঁড়ায় পথিকও। চরাঞ্চলে উৎপাদিত কুমড়া এ অঞ্চলের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে।

সরেজমিনে গঙ্গাচড়া উপজেলার চর মর্নেয়া, শংকরদহ, ধামুর, কোলকোন্দ, শিঙ্গীমারী ও নোহালী চর এলাকায় দেখা যায়, আবাদকৃত মিষ্টি কুমড়া উত্তোলনে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন কৃষকরা। চর শিঙ্গিমারীর চাষি ইলিয়াছ মিয়া, মতিয়ার মিয়া, হরিকান্ত বর্মণ, আরতী রানী, ঝুমু রানী ও বিলকিস বেগম জানান, তারা গত তিন বছর ধরে মিষ্টি কুমড়ার চাষ করছেন।

কাউনিয়া উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের রাজিব গ্রামের দিনেশ চন্দ্র, শফিকুল, তালুক সাহবাজ গ্রামের আব্দুল খালেক ও হরিচরণ শর্মা গ্রামের শফিকুল ইসলাম জানান, তাদের বাপ-দাদার আমলে কখনো এসব বালুচরে কোনো ফসলের চাষ হয়নি। এবার এলাকার চাষিরা প্রত্যেকে ২০০ থেকে ২৫০টি গাদায় (পিট) কুমড়া চাষ করেছেন। তারা জানান, নভেম্বর মাসে একটি করে গাদায় দুই থেকে তিনটি চারা রোপণ করা হয়। এতে তাদের খরচ হয়েছে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা। ইতিমধ্যে প্রত্যেক চাষির কুমড়া বিক্রয় হয়েছে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকায়। জমিতে আরো যে পরিমাণ কুমড়া রয়েছে তা ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করা যাবে।

আরও পড়ুন   লাউয়ের ফলন বৃদ্ধির উপায়

উদ্ভাবিত কৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসনে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও প্রাকটিক্যাল অ্যাকশন চলতি বছর গঙ্গাচড়া উপজেলার চারটি ইউনিয়নের প্রায় ১৯০ হেক্টর এবং কাউনিয়া উপজেলার প্রায় ৭৩ হেক্টর বালুচরে মিষ্টি কুমড়ার চাষ করেছে। উৎপাদিত কুমড়া বর্তমানে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি হচ্ছে।

কাউনিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শামিমুর রহমান ও গঙ্গাচড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, চলতি মৌসুমে তিস্তার বালুচরে অল্প খরচে অধিক ফলন ও দাম পেয়ে চাষিরা কুমড়া চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

প্রাকটিক্যাল অ্যাকশন, বাংলাদেশের এক্সট্রিম প্রোভার্টি প্রোগ্রাম হেড এ জেড এম নজমুল ইসলাম চৌধুরী জানান, ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চরাঞ্চলের তিন হাজার ২৭৩ জন চাষি এক হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে ৩৩ হাজার মেট্রিকটন কুমড়া উৎপাদন করেন। যার স্থানীয় বাজার মূল্য ২২ কোটি টাকা। এ সফলতার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে ২০০৯ সালে সরকার ও ডিএফআইডি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচটি জেলায় ইইপি সিঁড়ি প্রকল্পের মাধ্যমে মিষ্টি কুমড়া চাষ সম্প্রসারণে সহায়তা করে।

২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রাকটিক্যাল অ্যাকশন, বাংলাদেশের এ উদ্যোগের সফলতা তুলে ধরে তিনি জানান, ‘পাথওয়েজ ফ্রম প্রোভার্টি’ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৯ হাজার ২৫ হেক্টর বালুচর চাষের আওতায় আনা হয়। ওই বছরগুলোতে ১২ হাজার ৮৫৭ জন ভূমিহীন দরিদ্র চাষি প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিকটন মিষ্টি কুমড়া উৎপাদন করেন। যার বাজার মূল্য ৩৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

নজমুল ইসলাম বলেন, ‘মিষ্টি কুমড়া উৎপাদনের এ প্রযুক্তি ভূমিহীনদের মধ্যে আশার আলো হিসেবে ধরা দিয়েছে। শুধু প্রকল্পের চাষিরাই নন, এর বাইরের চাষিরাও এ প্রযুক্তি অনুসরণ ও গ্রহণ করে উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি সাফল্য পাচ্ছেন। ‘ ভূমিহীনরা যেন তাদের কষ্টের ফসলের ন্যায্য দাম পান, তাও নিশ্চিত করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দেশের বাজারে তৃণমূল চাষিদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। এ কারণে আমরা দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন বাজারের সঙ্গে তাদের সংযোগ করে দিচ্ছি। বর্তমানে একাধিক দেশে এসব মিষ্টি কুমড়া রপ্তানি হচ্ছে। ‘

আরও পড়ুন   পেয়ারার ফল শুকিয়ে যাওয়া সমস্যা

দেশের নদীভাঙন কবলিত হতদরিদ্র মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক সময়ের পতিত বালুচরে মিষ্টি কুমড়া চাষের এ প্রযুক্তির সফলতা এখন প্রমাণিত। তিস্তাসহ দেশের ৩০ থেকে ৪০টি নদীভাঙন এলাকায় লক্ষাধিক পরিবার সব কিছু হারিয়ে বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধের ওপর বসবাস করে। বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে যদি এ প্রযুক্তির আওতায় আনা যায়, তবে কৃষি উৎপাদনসহ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে বিপ্লব ঘটবে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে দিন

Comments are closed.

© All rights reserved © 2014 Ajkerkrishi.com
Developed By One Planet Web