আজ সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:১০ পূর্বাহ্ন
মিষ্টি গাছ স্টেভিয়া চাষ পদ্ধতি
বাংলাদেশে অনেক আধুনিক ফসল চাষ হচ্ছে এরই ধারাবাহিকতায় আজকে আলোচনা করবো মিষ্টি গাছ স্টেভিয়া চাষ পদ্ধতি নিয়ে ভালো মনোযোগ দিয়ে পড়ুন আর শেয়ার করে দিন।
মানুষের জীবনে মেধার বিকাশ এবং শারীরবৃত্তীয় পরিপক্বতা আসতে সাধারণত সময় লাগে ৪০ বছর। এ বয়সে সুস্থ ও ভালো থাকা বিষয়টি যত না অনুভূত হয় তার চেয়ে অনেক বেশি ভুক্তভোগী হতে হয় বয়স ৪০ এর কোঠা পার হতে না হতেই। ইতোমধ্যে চোখে কম দেখা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, চুল পাকা, ইন্দ্রিয় শৈথিল্যতা, ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিকস, বাত, গ্যাস্টিক, আলসার, ক্যান্সার ইত্যাদি অসুস্থতার উপসর্গগুলো দেখা দিতে থাকে।
এমতাবস্থায় ভালো থাকা ও সুস্থ থাকা একদিকে যেমন ওষুধনিভর্র হয়ে পড়ে অপরদিকে তেমন কমতে থাকে খাওয়া-পরার উৎকর্ষতা এবং অন্যান্য ভোগবিলাসের কৃচ্ছ্রতা কিংবা স্বাধীনতা। আর আমাদের দেশে এ বয়সে অসুস্থতার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হলো-হাইপারটেনশন বা ব্লাডপ্রেসার এবং ডায়াবেটিস রোগ। এমতাবস্থায় দেহের কোলস্টেরল কমাতে চর্বি জাতীয় সুস্বাদু উন্নত খাবার খাওয়া যেমন নিষিদ্ধ হয়ে যায় ডায়াবেটিস থেকে রেহাই পেতেও তেমনি ক্যালরিযুক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার পরিহার করতে হয়।
কিন্তু আকর্ষণীয় খাবার টেবিলে বসে জিহবার চাহিদা, চোখের ক্ষুধা ও মনের ক্ষুধা তো আর সহজে দমন করা যায় না। কিন্তু ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন হলো জীবনধারণের জন্য শাকসবজি জাতীয় ভেষজ ও নিরামিষ খাবার খাওয়া। তবে ভেষজ খাবার কেবল পরিহারযোগ্য খাবারের বিকল্পই নয় বরং মনের ক্ষুধা, চোখের ক্ষুধা, জিহবার চাহিদা এমনকি ঔষধির চাহিদা পূরণ করে থাকে। ঠিক এমনি এক ভেষজগুণে সমৃদ্ধ গুল্মজাতীয় মিষ্টি গাছ স্টিভিয়া। অবিশ্বাস্য হলেও আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুখবর বৈকি। এ যেন সৃষ্টিকর্তার এক অলৌকিক সৃষ্টি রহস্য।
স্টিভিয়ার পরিচিতি এবং উদ্ভিদ প্রকৃতিঃ
স্টিভিয়া মূলত অনেক আগে থেকেই প্যারাগুয়ের পাহাড়ি অঞ্চলে শত শত বছর ধরে চাষাবাদ করা হতো তবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সেখানে চাষাবাদ শুরু হয় ১৯৬৮ সনে। অতপর ব্রাজিল, চীন, কোরিয়া, কানাডা, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে ফসল হিসেবে গাছটির চাষ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বর্তমানে চীনে ব্যাপকভাবে স্টিভিয়ার চাষ হয়ে থাকলেও বাণিজ্যিক ব্যবহারের দিক দিয়ে জাপান অনেক অগ্রসর। জাপানে প্রায় ৪০% চিনির চাহিদা মেটানো হয়ে থাকে স্টিভিয়া দিয়ে। অতি আনন্দের বিষয় স্টিভিয়া পার্শ্ববর্তী দেশসহ বর্তমানে আমাদের দেশেও দিন দিন ব্যাপক পরিচিতি লাভ করছে। সৃষ্টিকর্তার অলৌকিক সৃষ্টি রহস্য অস্বাভাবিক মিষ্টি এবং ভেষজগুণ সম্পন্ন এ স্টিভিয়া গাছটির উদ্ভিদতাত্ত্বিক সংপ্তি পরিচিতি হলো-স্টিভিয়া কম্পোজিট ফ্যামিলির অন্তর্ভুক্ত বহু বর্ষজীবী গুল্মজাতীয় একটি ভেষজ উদ্ভিদ।
স্টিভিয়া সর্বোচ্চ ৬০-৭০ সেন্টিমিটার উচ্চতা বিশিষ্ট হয়। সবুজ রঙের পাতাগুলো কান্ডের সাথে বিপরীতমুখী বিন্যাসে থাকে এবং পাতার কিনারা খাঁজ কাটা ও বর্শাকৃতির। উদ্ভিদটি অনেকটাই এ্যাস্টার ফুল গাছের মতো। এর ফুল ছোট ও সাদা রঙের এবং কীটপতঙ্গ দ্বারা পরাগায়িত। বীজ এন্ডোস্পারম যুক্ত ক্ষুদ্রাকৃতির। স্টিভিয়া সাধারণত রৌদ্র পছন্দের এবং ছোট দিনের উদ্ভিদ। তবে রৌদ্র পছন্দের হলেও দিনের ভাগ ১৩ ঘণ্টার বেশি অপছন্দনীয়। স্টিভিয়া গাছটির সবুজ পাতাই মূলত কার্যকরী মিষ্টি উপাদানের প্রধান উৎস।
স্টিভিয়ার গুণাগুণঃ
স্টিভিয়ার অতি গুরুত্বপূর্ণ গুণ বৈশিষ্ট্য হলো এর মিষ্টতায় কোনো ক্যালোরি কিংবা কার্বোহাইড্রেট নেই। ফলে দেহে কখনো শোষিত হয় না কিংবা কোনো তাপ উৎপাদন করে না। শুধু মিষ্টি ও চর্বিযুক্ত খাবারের চাহিদাই পূরণ করে থাকে যা ডায়াবেটিস ও ব্লাড প্রেসার রোগীদের জন্য মিষ্টির বিকল্প হিসেবে এক মহা সুখবর বৈকি। এ যেন সৃষ্টিকর্তার এক অলৌকিক নিদর্শন।
কারণ এটি অকল্পনীয়ভাবে মানুষের দেহে অগ্ন্যাশয় হতে ইনসুলিন নিঃসরণে সহায়তা করে এবং ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে স্টিভিয়া হাইপারটেনশন রোগীদেরও উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করে। শুধু তাই নয়, শরীরের সুস্থতা ও সচেতনতাবোধ সৃষ্টিসহ উদ্দীপক ও কান্তিনাশক হিসেবে স্টিভিয়ার ব্যবহার অদ্বিতীয়। এ ছাড়াও দাঁতে ব্যাকটেরিয়াজনিত তি ও য় রোধে স্টিভিয়া যেমন অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে তেমনি পাকস্থলিতে হজমে সহায়তা করে। যকৃত, অগ্ন্যাশয় ও প্লীহায় পুষ্টি সরবরাহ করে এবং ত্বকের য় নিরাময় করে।
চাষ পদ্ধতিঃ
জৈব সারযুক্ত ও নিষ্কাশনযুক্ত দো-আঁশ মাটি এবং সাধারণত ১৫-৩০ সেলিসিয়াস তাপমাত্রা স্টিভিয়া চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এ কারণে আমাদের দেশে প্রায় সারা বছরই মাঠ ফসল হিসেবে স্টিভিয়ার চাষ করা যায়। বাড়ির বারান্দায় রৌদ্রযুক্ত স্থানে কিংবা বাড়ির ছাদে ৫-৬ ইঞ্চি টবে কিংবা পলিথিনে চারা রোপণের মাধ্যমে ইতোমধ্যে স্টিভিয়ার চাষ ব্যাপকতা লাভ করেছে।মাঠ ফসল হিসেবে স্টিভিয়ার চাষ এত লাভজনক যে একজন চাষি প্রতি বছর বিঘাপ্রতি কয়েক লাখ টাকা অনায়াসে আয় করতে পারেন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গাছটি চাষ করে ইতোমধ্যে একরপ্রতি ২.০-২.৫ লাখ রুপি মুনাফা অর্জন করছে।
আমাদের দেশেও সংশ্লিষ্ট কৃষি বিজ্ঞানীরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গাছটির চাষাবাদ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা কার্যক্রম চালালে কৃষক পর্যায়ে আরো ব্যাপকতা লাভ করতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে ব্যাপক হারে চাষের জন্য বীজ একটি বড় সমস্যা। বীজ সমস্যার কারণে আমাদের দেশে গাছটি আপাতত টিস্যু কালচারের মাধ্যমে ব্যাপকতা লাভ করেছে। ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র, ঈশ্বরদী এবং ব্র্যাক টিস্যু কালচার ল্যাবরেটরি, গাজীপুর এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। পলিথিনে এবং টবে করে বিক্রি হচ্ছে স্টিভিয়ার চারা। আগ্রহী ক্রেতাদের ভিড় দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
স্টিভিয়ার ব্যবহারঃ
যাদের ডায়াবেটিস কিংবা ব্লাড প্রেসার আছে তারা নিজ বসতবাড়িতে মাত্র দু-একটি টবে বহু বর্ষজীবী এ গাছ যত্ন সহকারে চাষ করলে পরিবারে চিনির চাহিদা পূরণ করা কোনো ব্যাপারই নয়। প্রতি ১ কেজি খাবার মিষ্টিকরণের জন্য মাত্র ৭.৯ মিলিগ্রাম স্টিভিয়া যথেষ্ট। এক গ্লাস পানিতে ১-২টি কাঁচা পাতার রস মিশিয়ে দিলেও অনেক মিষ্টি পাওয়া যায়। তাই সরবত, চা, কফি, সেমাই এবং অন্যান্য পানীয় দ্রব্যে ব্যবহার্য মিষ্টি উপাদান হিসেবে স্টিভিয়া ব্যবহার করা যেতে পারে।
স্টিভিয়ার পাতা গুঁড়া করে পাউডার, ট্যাবলেট কিংবা তরল প্যাকেজে বাজারজাত করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, এক কেজি কাঁচা পাতা শুকিয়ে প্রায় ২০০-৩০০ গ্রাম পাউডার পাওয়া যেতে পারে। এসব তরল কিংবা পাউডার অথবা স্টিভিয়া হতে উৎপাদিত চিনি পাউরুটি এবং বিস্কুট তৈরির কারখানাগুলোতে ডায়াবেটিক্স্ ও ব্লাড প্রেসার রোগীদের জন্য বিশেষ রুটি ও বিস্কুট তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিস ও ব্লাড প্রেসার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এবং এ দেশ স্টিভিয়া চাষের জন্য খুবই উপযোগী প্রোপটে কৃষি বিজ্ঞানী, চাষি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপ ব্যাপক হারে স্টিভিয়া চাষের ব্যাপারে উদ্যোগী হলে এ উদ্ভিদটি এ দেশের কৃষি সেক্টরে তো বটেই জাতীয় রাজস্ব খাতেও ব্যাপক সাড়া জাগাতে পারে। এ ছাড়াও হোমিও, সাধনা, আয়ুর্বেদিক এবং কবিরাজিসহ ভেষজ গাছ-গাছড়া নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারাও স্টিভিয়া থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারেন। কৃষি প্রধান এবং চাষ উপযোগী বাংলাদেশে স্টিভিয়ার ব্যাপক চাষ, গবেষণা ও সংশ্লিষ্ট শিল্প কারখানা চালু করতে পারলে এ দেশের আর্থ-সামাজিকসহ জাতীয় উন্নয়ন খাতে কাঙিক্ষত প্রবৃদ্ধি অতি সম্ভাবনাময়।
চিনি, তবু চিনি নয় পরিশোধিত চিনির ঝুঁকি বিস্তর। তাই বলে তো আর চিনি খাওয়া থেমে থাকবে না। পরিশোধিত চিনির জায়গায় এসেছে প্রাকৃতিক চিনি স্টিভিয়া। বিশ্ববাজারে হু হু করে বাড়ছে এই চিনির কদর।
বিবিসি অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, স্টিভিয়া একধরনের গাছ। জাপান, প্যারাগুয়ে, ব্রাজিলের মতো দেশে পরিশোধিত চিনির বিকল্প হিসেবে স্টিভিয়া ব্যবহূত হয়। গুটিকয়েক দেশের মধ্যে এখন আর এই চিনির গণ্ডি সীমাবদ্ধ নয়। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় দেশগুলোর শপিং মলেও মিলছে স্টিভিয়া। প্রাকৃতিক এই চিনি ব্যবহারে ক্রেতাদের আগ্রহও অনেক।
জাপানে প্রায় ৪০ বছর ধরে স্টিভিয়ার প্রচলন রয়েছে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র খাদ্যে সামান্য পরিমাণ স্টিভিয়া মেশানোর অনুমোদন দিয়েছে। ২০১১ সালে অনুমোদন দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
বিশ্বের খ্যাতনামা কোম্পানিগুলো এই চিনি লুফে নিয়েছে। বৈশ্বিক বাজার গবেষণাপ্রতিষ্ঠান মিনটেলের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে স্টিভিয়ানির্ভর খাদ্যপণ্যের ব্যবহার ৪০০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১১ থেকে ২০১২ সালে তা বেড়েছে ১৫৮ শতাংশ।
ব্রিটিশ ভিটামিন খুচরা বিক্রেতা চেইন হোলল্যান্ড অ্যান্ড বারেট বলছে, গত বছর একই সময়ের তুলনায় গত চার সপ্তাহে স্টিভিয়ার বিক্রি ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
সম্প্রতি কোমল-পানীয় কোম্পানি কোকা-কোলা স্প্রাইটের রেসিপি পরিবর্তন করে স্টিভিয়া ব্যবহার করেছে।
খাদ্য প্রস্তুতকারী বিভিন্ন কোম্পানি ও কোমল-পানীয় উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান এখন পরিশোধিত চিনির পরিবর্তে স্টিভিয়ার দিকে ঝুঁকছে।
কারণ, পরিশোধিত চিনি স্থূলতার জন্য দায়ী। যুক্তরাজ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষ স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন সমস্যায় ভুগছে। এ ছাড়া পরিশোধিত চিনি নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। এর পেছনে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ খরচ গুনতে হচ্ছে দেশটির নাগরিকদের।
স্টিভিয়া খাদ্য ও কোমল-পানীয় শিল্পের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের দাবি, স্টিভিয়ায় কোনো ক্যালরি নেই। নেই শ্বেতসার। এটি রক্তে চিনির মাত্রাও বাড়ায় না; বরং সবদিক থেকে স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। ব্রিটিশ নিউট্রিশন ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ পুষ্টিবিজ্ঞানী লরা ওয়েনিসের মতে, ওজন ব্যবস্থাপনায় স্টিভিয়া খুবই উপকারী। এ ছাড়া দাঁতের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও বহুমূত্র রোগের ক্ষেত্রে এই চিনি বেশ উপকারী।