সরিষা চাষ কনটেন্টটিতে সরিষা চাষ কীভাবে করা যায়, চাষ করার জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে কিনা, এক বিঘা জমির উৎপাদন খরচ, এর পুষ্টিমান এবং সর্বোপরি এর মাধ্যমে কীভাবে বাড়তি আয় করা সম্ভব, সে বিষয় সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।
সরিষা চাষ
সরিষা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান তৈল বীজ ফসল। এর ইংরেজি নাম Mustard ও বৈজ্ঞানিক নাম Brassica spp. সরিষার তেল শহর গ্রাম সবখানে খুবই জনপ্রিয়। আমাদের দেশের অনেক জমিতে সরিষার চাষ হয়ে থাকে। এই চাষ করা সরিষা থেকে প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ টন তেল পাওয়া যায়। আমাদের দেশের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ভোজ্য তেলের জন্য সরিষার উপর নির্ভর করে। আমাদের দেশে কুমিল্লা, ঢাকা, পাবনা ও রাজশাহীর অনেক জায়গায় এখন ব্যবসায়িক ভিত্তিতে সরিষার চাষ ও বাজারজাত করা হচ্ছে।
পুষ্টিগুন
সরিষার বীজে গড়ে প্রায় ৪০-৪৪ ভাগ তেল থাকে।
বাজার সম্ভাবনা
আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান তেল হলো সরিষার তেল। সরিষার তেল শহর ও গ্রামে খুবই জনপ্রিয়। সরিষার খৈল গরু ও মহিষের জন্য খুব পুষ্টিকর খাদ্য। এছাড়া মাটির জন্য খৈল খুব উন্নতমানের জৈব সার। তাই সরিষা উৎপাদন করে পারিবারিক ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এর খৈল দিয়ে গবাদি পশুর খাদ্য, মাছের খাদ্য ও জমির জন্য জৈব সার তৈরি করা সম্ভব। এসব থেকে বাড়তি আয় করাও সম্ভব। সরিষার তেল বিভিন্ন খাবার রান্না ও স্বাদ বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। দেশের চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত উৎপাদন বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সহায়তা দিয়ে থাকে। সরিষা বিদেশে রপ্তানি করার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
সরিষা উৎপাদন কৌশল
জাত
আমাদের দেশে ৩ প্রকার সরিষার চাষ হয়। যথা: টরি, শ্বেত ও রাই। এছাড়া বর্তমানে নেপাস সরিষার চাষ উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং এর আবাদও হচ্ছে। সরিষার অন্যান্য জাত ও চাষ সময়সমূহ হচ্ছে :
নাম | হাজার বীজের ওজন (গ্রাম) | বীজে তেলের পরিমাণ (%) | বোনা হতে পাকা পর্যন্ত সময় (দিন) |
টরি | ২.৬-২.৭ | ৩৮-৪১ | ৭০-৮০ |
সোনালি সরিষা (এস এস-৭৫) | ৩.৫-৪.৫ | ৪৪-৪৫ | ৯০-১০০ |
কল্যাণীয়া (টি এস-৭২) | ২.৫-৩.০ | ৪০-৪২ | ৭৫-৮০ |
দৌলত (আর এস-৮১) | ২.০-২.৫ | ৩৯-৪০ | ৯০-১০৫ |
বারি সরিষা-৬ (ধানি) | ৩-৪ | ৪৪-৪৫ | ৯০-১০০ |
বারি সরিষা-৮ (ন্যাপাস-০৯) | ৩.৪-৩.৬ | ৪৩-৪৫ | ৯০-৯৫ |
রাই-৫ | ১.৭-১.৯ | ৩৯-৪০ | ৯০-১০০ |
তথ্যসূত্র : কৃষি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, জুন ২০০৭, Microfinance for Marginal and Small Farmers (MFMSF) Project, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট সেল-১, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), ঢাকা।
* চাষের উপযোগী পরিবেশ ও মাটি
জলবায়ু | মাটির প্রকৃতি |
বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য এবং জমির জো অবস্থা অনুসারে টরি-৭, কল্যাণীয়া, সোনালি সরিষা, বারি সরিষা-৬, রাই-৫ এবং দৌলত কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ (মধ্য-অক্টোবর থেকে মধ্য-নভেম্বর) মাস পর্যন্ত বপন করা যেতে পারে। | সরিষা চাষের জন্য দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও পলি মাটি উপযুক্ত। সহজে পানি নিষ্কাশন করা যায় এরকম মাটির জমি নির্বাচন করতে হবে। |
জমি তৈরি
- সরিষার জমি এমন ঝুরঝুরা করে চাষ করতে হবে যাতে সহজেই বীজ থেকে চারা গজাতে পারে।
- জমি ৫-৬ বার আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে পরিপাটি করতে হবে।
- সরিষা জমির বড় বড় ঢেলা ভেঙ্গে সমতল করতে হবে। যাতে জমির কোথাও পানি জমতে না পারে।
- জমির চারপাশে নালার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে পরে সেচ দিতে ও পানি নিকাশে সুবিধা হবে।
বীজ বপন
- সাধারণত সরিষা বীজ ছিটিয়ে বপন করা হয়। এছাড়া সারিতেও বীজ বপন করা হয়।
- ছিটিয়ে বুনলে শেষ চাষে বীজ বপন করে মই দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
- সারিতে বীজ বুনলে এক সারি থেকে অন্য সারির দূরত্ব ৩০ সে. মি. রাখতে হবে।
- ২-৪ সে.মি. গভীরতায় সরিষার বীজ বপন করতে হবে।
- সরিষার বীজ ছোট। তাই বপনের সুবিধার জন্য বীজের সাথে ঝুরঝুরে মাটি অথবা ছাই মিশিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
- সারি করে বুনলে জমিতে সার, সেচ ও নিড়ানি দিতে সুবিধা হবে।
- বপনের সময় জমিতে বীজের অংকুরোদগমের উপযোগী রস থাকতে হবে। মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে ২-৩ দিনের মধ্যে চারা গজাবে।
সার প্রয়োগ
কৃষকদের মতে গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে সরিষা চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরণ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে। বাড়িতে গবাদি পশু থাকলে সেখান থেকে গোবর সংগ্রহ করা যাবে। নিজের গবাদি পশু না থাকলে পাড়া-প্রতিবেশি যারা গবাদি পশু পালন করে তাদের কাছ থেকে গোবর সংগ্রহ করা যেতে পারে। এছাড়া ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে আবর্জনা পচা সার ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়ির আশে-পাশে গর্ত করে সেখানে আবর্জনা, ঝরা পাতা ইত্যাদি স্তুপ করে রেখে আবর্জনা পচা সার তৈরি করা সম্ভব।
সেচ
- সোনালি সরিষা, বারি সরিষা-৬, বারি সরিষা-৭ ও বারি সরিষা-৮ উফশী জাতসমূহে পানি সেচ দিলে ফলন বেশি হয়।
- বীজ বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে (গাছে ফুল আসার আগে) প্রথম সেচ এবং ৫০-৫৫ দিনের মধ্যে (ফুল ধরার সময়) দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে।
- বপনের সময় মাটিতে রস কম থাকলে চারা গজানোর ১০-১৫ দিনের মধ্যে একটি হালকা সেচ দিতে হবে।
- সরিষা জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই সেচের পানি জমিতে বেশি সময় জমতে দেওয়া যাবে না।
রোগবালাই
সরিষার জাব পোকা : জাব পোকা হচ্ছে সরিষার প্রধান ক্ষতিকর পোকা। পূর্ণবয়স্ক ও বাচ্চা পোকা উভয়ই সরিষার পাতা, কান্ড, ফুল ও ফল হতে রস শোষণ করে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে ফুল ও ফলের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং পাতা কুঁকড়ে যায়। জাব পোকা এক ধরণের রস নিঃসরণ করে, ফলে তাতে সুটিমোল্ড ছত্রাক জন্মে এবং আক্রান্ত অংশ কালো দেখায়। এজন্য ফল ঠিকমত বাড়তে পারে না; বীজের আকার ছোট হয়। বীজে তেলের পরিমাণ কমে যায়। ফল ধরা অবস্থায় বা তার আগে আক্রমণ হলে এর প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সম্পূর্ণ ফসল নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে।
সরিষার পাতা ঝলসানো রোগ : অলটারনারিয়া ব্রাসিসি নামক ছত্রাক দিয়ে সরিষার পাতা ঝলসানো রোগ সৃষ্টি হয়। প্রাথমিক অবস্থায় সরিষা গাছের নীচে বয়স্ক পাতায় এ রোগের লক্ষণ দেখা যায়। পরে এ ছত্রাকের আক্রমণের গাছের পাতা, কান্ড ও ফলে গোলাকার কালচে দাগের সৃষ্টি হয়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাতা ঝলসে যায়। ফলে সরিষার ফলন খুব কমে যায়।
পরজীবী উদ্ভিদজনিত রোগ : সরিষার পরজীবি উদ্ভিদের মধ্যে অরোবাংকিই প্রধান। সরিষা গাছের শেকড়ের সাথে এ পরজীবী উদ্ভিদ সংযোগ স্থাপন করে খাদ্য সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে। এর ফলে পরজীবী আক্রান্ত সরিষার গাছ দুর্বল হয়, বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন হ্রাস পায়। অরোবাংকি এক প্রকার সপুষ্পক পরজীবী উদ্ভিদ এবং এর বংশ বৃদ্ধি সরিষা গাছের উপর নির্ভরশীল। এর বীজ মাটিতেই অবস্থান করে। মাটি, ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, সেচের পানি প্রভৃতির মাধ্যমে অরোবাংকির উৎপত্তি ও বিস্তার ঘটে। বারবার একই জমিতে সরিষা পরিবারের ফসল চাষ করলে এ পরজীবীর বিস্তার ঘটে।
প্রতিকার
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে পোকা দমন না হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে।
চাষের সময়ে পরিচর্যা
- চারা খুব ঘন হলে পাতলা করে দিতে হবে। পাতলা করার কাজ চারা গজানোর ১০-১৫ দিনের মধ্যে করতে হবে।
- জমির কোথাও একদম চারা না গজালে প্রয়োজনে সেখানে আবার বীজ বপন করতে হবে।
- সরিষার জমিতে আগাছা দেখামাত্র নিড়ানি দিয়ে তুলে ফেলতে হবে। বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর একবার ও ফুল আসার সময় দ্বিতীয়বার নিড়ানি দিতে হবে।
ফসল সংগ্রহ
ক্ষেতের শতকরা ৮০ ভাগ সরিষার ফল যখন খড়ের রঙ ধারণ করে এবং গাছের পাতা হলুদ রঙ ধারণ করে তখন ফসল সংগ্রহ করার উপযুক্ত সময়। সকালে ঠান্ডা আবহাওয়ায় শিশির ভেজা অবস্থায় ফসল সংগ্রহ করা ভালো। মূলসহ গাছ টেনে তুলে অথবা কাঁচি দিয়ে কেটে ফসল সংগ্রহ করা যায়। তবে টেনে তোলাই ভালো।
ফসল মাড়াই ও সংরক্ষণ
- ফসল সংগ্রহের পর ৩/৪ দিন রোদে শুকিয়ে মাড়াই করতে হবে।
- মাড়াই করার পর বীজগুলোকে ঝেড়ে পরিষ্কার করে ৩/৪ দিন রোদে শুকাতে হবে।
- এর মধ্যে কিছু অপুষ্ট বীজ থাকতে পারে। অপুষ্ট বীজগুলো আলাদা করতে হবে।
- পরিষ্কার শুকনা পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করলে ১-২ বছর রাখা সম্ভব
উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ
প্রতি বিঘা জমিতে প্রতিবছর প্রায় ১১০ কেজি সরিষার ফলন হয়ে থাকে।
সরিষা উৎপাদন খরচ
* ১বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে ফসল উৎপাদন খরচ
খরচের খাত | পরিমাণ | আনুমানিক মূল্য (টাকা) |
বীজ | ২ কেজি | ১০০ |
জমি তৈরি | চাষ ও মই | ৬০০ |
পানি সেচ | ২-৩ বার | ৬০০ |
শ্রমিক | ৪জন (প্রতিজন=২০০ টাকা) | ৮০০ |
সার | প্রয়োজন অনুসারে জৈব সার | নিজস্ব |
টিএসপি=৩৩ কেজি (১ কেজি=২৫ টাকা)
ইউরিয়া=৪০ কেজি (১ কেজি=১৩ টাকা) পটাশ=৮ কেজি (১ কেজি=৩০ টাকা) |
১৫৮৫ | |
কীটনাশক | প্রয়োজন অনুসারে জৈব বা রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার | নিজস্ব/দোকান |
জমি ভাড়া | একবছর | ৪০০০ |
মাটির জৈব গুণাগুণ রক্ষা ও উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য জৈব সার ও জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে লাভের পরিমাণ বাড়তে পারে। |
তথ্যসূত্র : মাঠকর্ম, ঘিওর, মানিকগঞ্জ, অক্টোবর ২০০৯।
মূলধন
এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে সরিষা চাষের জন্য ২৫০০-৩৫০০ টাকার প্রয়োজন হবে। মূলধন সংগ্রহের জন্য ঋণের প্রয়োজন হলে নিকট আত্মীয়স্বজন, সরকারি ও বেসরকারি ঋণদানকারী ব্যাংক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও)- এর সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এসব সরকারি ও বেসরকারি ঋণদানকারী ব্যাংক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) শর্ত সাপেক্ষে ঋণ দিয়ে থাকে।
প্রশিক্ষণ
সরিষা চাষের আগে অভিজ্ঞ কারও কাছ থেকে সরিষা চাষ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিতে হবে। এছাড়া চাষ সংক্রান্ত কোন তথ্য জানতে হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্ধারিত ফি এর বিনিময়ে কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
সরিষা একটি উন্নতমানের তেল ফসল। সরিষা চাষ করে তা থেকে তেলের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। সরিষা চাষ করে পারিবারিক চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি অতিরিক্ত উৎপাদন বাজারে বিক্রি করে বাড়তি আয় করা সম্ভব।
টাঙ্গাইলে সরিষা থেকে মধু আহরণে লাভবান হচ্ছেন চাষীরা
টাঙ্গাইল জেলার সর্বত্রই সরিষার আবাদ হয়েছে। চোখ জুড়িয়ে যায় সরিষা ফুল দেখে। আর সরিষা ক্ষেতের আশপাশে সারিবদ্ধভাবে মৌ বাক্স স্থাপন করা হয়েছে। এসব বাক্সে পালিত মৌমাছি সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌ বাক্সে জমা করছে।আর এই মৌ বাক্সে জমা করা মধু সংগ্রহ করছেন মৌ চাষীরা। মৌ চাষের মাধ্যমে তারা একদিকে যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। অন্যদিকে দূর হচ্ছে বেকারত্ব। আর এই মধু দেশের বিভিন্ন স্থানসহ বিদেশেও বিক্রি হচ্ছে।
সরিষা ফুলের মধু যেমন খাঁটি তেমনি সুস্বাদুও। মানের দিক থেকেও উন্নত হওয়ায় এ মৌসুমে মধুর চাহিদাও বেশি থাকে। মধু উচ্চমাত্রার প্রাকৃতিক এন্টিবায়োটিক হওয়ায় এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি ও ক্রেতাদের কাছে।
ক্রেতারা মৌ খামারে এসে সরাসরি চাষীদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন মধু।
সরেজমিনে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, সরিষা ক্ষেতের পাশে সারিবদ্ধভাবে মৌ বাক্স স্থাপন করা হয়েছে। আর মৌ মাছিরা সরিষা থেকে মধু আহরণ করে বাক্সে জমা করছে। আর এই বাক্স থেকে চাষীরা মধু সংগ্রহ করছেন।সরেজমিনে দেখা যায়, মৌ বাক্সের চারদিকে মৌমাছি ঘুরাঘুরি করছে। ওই স্থানে মৌ মাছিদের এক মিলন মেলা তৈরি হয়েছে। এই সরিষা থেকে মধু আহরণের দৃশ্য দেখার জন্য অনেকেই ভিড় করছেন।
জানা যায়, টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা স্থানীয় কৃষকদের মাধ্যমে সরিষা ক্ষেতে মধু আহরণের জন্য বাক্স স্থাপন করেছেন মৌ চাষীরা। জেলার প্রায় সব উপজেলায়ই চলছে এ কার্যক্রম।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার সস্তায় মৌ চাষী আমিরুল রহমান পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, এ বছর আমি সরিষা ক্ষেতে শতাধিক মৌ বাক্স স্থাপন করেছি।আমরা সরিষা ক্ষেতে বছরে ৪ মাস মধু আহরণ করে থাকি। অন্য ৮ মাস কৃত্রিম পদ্ধতিতে চিনি খাইয়ে মৌ মাছিদের রাখা হয়। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সরিষা থেকে মধু আহরণের উপযুক্ত সময়। তখন জেলায় সর্বত্রই ভালো সরিষা ফুল ফোটে।
তিনি আরো বলেন, আকার ভেদে একটি বাক্সে ১৫ থেকে ৪০ কেজি পর্যন্ত মধু পাওয়া যায়। আর এই প্রতিটি বাক্সে খরচ হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। প্রতি বাক্সে লাভ হয় ৫ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, এ বছর আমাদের লাভ হওয়া নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। কারণ বাজারে চিনির দাম বেশি এবং দেরিতে সরিষার আবাদ হওয়ায় লোকসান হতে পারে।
তিনি আরো বলেন, এখন পর্যন্ত আমি প্রায় ৫০ হাজার টাকার মধু বিক্রি করেছি। আমরা বিভিন্ন কোম্পানির কাছে মধু বিক্রি করে থাকি। কোম্পানির কর্মকর্তারা আমাদের কাছ থেকে মধু কিনে থাকেন।তিনি বলেন, সরিষা থেকে মধু আহরণে একদিকে যেমন বেকারত্ব দূর হয়। অন্যাদিকে অল্প সময়ের মধ্যে লাভবান হওয়া যায়।
আমিরুল ইসলাম জানান, তিনি ৮ বছর ধরে সরিষা থেকে মধু আহরণের কাজ করছেন। লিচু থেকেও মধু সংগ্রহ করেন তিনি। গত বছর তার প্রায় দেড় লাখ টাকা লাভ হয়েছিলো।
মৌ চাষী সুজন মিয়া বলেন, এ বছর আমি আড়াইশ বাক্স স্থাপন করেছি। প্রতিটি বাক্স থেকে সপ্তাহে গড়ে ৪ কেজি মধু সংগ্রহ করছি। মৌ চাষে আমাদের কোন সমস্যা হয়নি।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর টাঙ্গাইলের উপ-পরিচালক আবুল হাশিম পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, এ বছর টাঙ্গাইলে ৮ হাজার মৌ বক্স স্থাপনের টার্গেট ধরা হয়েছে, এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ হাজার বাক্স স্থাপন করা হয়েছে।গত বছর টার্গেট ধরা হয়েছিলো ৬০০০ হাজার কিন্তু বাক্স স্থাপন করা হয়েছিলো ৭ হাজার। আশা করছি এবছরও টার্গেটের থেকে বেশি মৌ বাক্স স্থাপন করা হবে।
তিনি আরো বলেন, মৌ বাক্স বসানোর কারণে সরিষা ফুলে পরাগায়ণের সাহায্য করে, এর ফলে সরিষার উৎপাদন ২০ ভাগ বেড়ে যায়। আমরা কৃষকদের মধু চাষের জন্য প্রশিক্ষণ দিচ্ছি এবং তাদেরকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছি। টাঙ্গাইলে ৭০ থেকে ৮০ জনের মতো মৌ চাষী রয়েছে।
তিনি জানান, মধু ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। টাঙ্গাইলের মধু দেশের বিভিন্ন স্থানসহ বিদেশেও বিক্রি করা হচ্ছে। এ বছর টাঙ্গাইলে সরিষার আবাদও ভালো হয়েছে। ফুলে কোন ধরনের পোকামাকড় ধরেনি। এর ফলে মৌ চাষীরা ব্যাপকহারে মধু পাবেন বলে তিনি মনে করেন।
টাঙ্গাইলের উপ-পরিচালক আশা করছেন ভবিষ্যতে আরো মৌ বাক্সে বৃদ্ধি পাবে। আর এ লক্ষে তারা কাজ করছেন।
তিনি বলেন, কয়েক বছর আগেও সরিষা চাষীরা তাদের জমিতে মৌ চাষীদের মৌ বাক্স স্থাপনে বাধা দিত। তাদের ধারণা ছিল মৌমাছির কারণে সরিষার ফলন কম হবে। তবে আমাদের কৃষি কর্মকর্তারা বোঝাতে সক্ষম হন মৌ চাষের কারণে সরিষার ফলন কমতো হয়ই না, বরং ফলন ভালো হয়। এরপর সরিষা চাষীরা তাদের জমির পাশে মৌ বাক্স স্থাপনে সহায়তা করে আসছেন।