আজ শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৮ পূর্বাহ্ন

কাঠলিচু বা আঁশফল চাষ

কাঠলিচু বা আঁশফল চাষ

আঁশফল বা কাঠ লিচু আমাদের দেশের স্থানীয় ফল হলেও গুণগতমান তেমন ভালো নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশে আঁশফল বেশ কিছু উন্নতমানের জাত প্রবর্তনের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করেছে। আঁশফল লিচু পরিবারের একটি সদস্য। ফলের উপরিভাগ মসৃণ, ফলের রঙ বাদামি, আকার গোল এবং লিচুর চেয়ে অনেক ছোট হলেও ফলের শাঁস অবিকল লিচুর মতো এবং ফল খেতে প্রায় লিচুর মতো বা লিচুর চেয়ে বেশি মিষ্টি।

আঁশফলে প্রচুর পরিমাণে শর্করা ও ভিটামিন ‘সি’ থাকে। এ ফলের শাঁস সাদা, কচকচে। আঁশফলের বীজ গোলাকার চকচকে কালো এবং শাঁস বীজকে আবৃত করে রাখে এবং সহজেই বীজ থেকে আলাদা করা যায়। সাধারণত আগস্ট মাসের শেষার্ধ থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত আঁশফল আহরণ করা হয়। ফলে দীর্ঘদিন ধরে লিচুর স্বাদ গ্রহণ ও ফলের মৌসুম দীর্ঘায়িত করতে আঁশফল বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

আঁশফলের বৈজ্ঞানিক নাম Euphoria longana। আঁশফল স্যাপিন্ডেসি (Sapindaceae) পরিবারভুক্ত একটি বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ।

এ পরিবারের আরও একটি ফল আছে, তার নাম রাম্বুতান। সম্প্রতি আঁশফল, রাম্বুতান ফল দুটি বাংলাদেশে সাফল্যজনকভাবে প্রবর্তন করা সম্ভব হয়েছে।

পুষ্টিমান ও ঔষধিগুণ

আঁশফলে বিভিন্ন খনিজ উপাদান, শর্করা ও ভিটামিন সি এর প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য অংশে ৭২ ভাগ পানি, ১০৯ কিলোক্যালোরি শক্তি, ৮.০ মিগ্রা. ভিটামিন সি, ২৮০ আইইউ ভিটামিন এ, ২.০ মি.গ্রা. ক্যালসিয়াম, ৬.০ মি.গ্রা. ফসফরাস, ১.০ গ্রাম প্রোটিন ও ০.৫ গ্রাম ফ্যাট বিদ্যমান। আঁশফলের শুকানো শাঁস ভেষজ ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। যেমন- এটি পাকস্থলীর প্রদাহে, অনিদ্রা দূর করতে ও বিষের প্রতিষেধক (antidote) হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর পাতা অ্যালার্জি, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও কার্ডিওভাসকুলার রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা যায়।

জলবায়ু ও মাটি

আঁশফল প্রধানত অবগ্রীষ্মম-লের ফল। তবে এর বাণিজ্যিক চাষ গ্রীষ্মম-ল পর্যন্ত বিস্তৃত। আঁশফল উষ্ণ ও আর্দ্র গ্রীষ্মকাল এবং শুষ্ক শীতকাল পছন্দ করে। হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রায় গাছ মারা যায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৫০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত স্থানে আঁশফল জন্মে। আঁশফলের জন্য বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ২০-২৫০সে. সবচেয়ে উপযোগী। রাতের তাপমাত্রা ২৫০সে. এর উপরে হলে ফলের বৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর। প্রায় সব ধরনের মাটিতেই আঁশফল চাষ করা যায়। তবে উর্বর সুনিষ্কাশিত গভীর দোঁ-আশ মাটি আঁশফল চাষের জন্য উত্তম। এ গাছ জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা একেবারে সহ্য করতে পারে না। ফল ধারণ থেকে ফলের পরিপক্বতা পর্যন্ত মাটিতে প্রচুর আর্দ্রতা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন   লেবু চাষের সহজ পদ্ধতি

জাত

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র স্থানীয় জার্মপ্লাজম থেকে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বারি আঁশফল-১ এবং ভিয়েতনাম থেকে প্রবর্তিত জার্মপ্লাজম থেকে বারি আঁশফল-২ নামে আঁশফলের দুটি উন্নত জাত বাংলাদেশের সর্বত্র চাষের জন্য মুক্তায়ন করেছে। এ জাত দুটি প্রতি বছর নিয়মিত ফল দেয় এবং এদের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ-

বারি আঁশফল-১ উচ্চফলনশীল নিয়মিত ফলদানকারী জাত। গাছ মাঝারি খাঁড়া প্রকৃতির ও মধ্যম ঝোপাল। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে গাছে ফুল আসে এবং শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে ফল ফল আহরণ উপযোগী হয়। ফল ছোট (৩.৫ গ্রাম), গোলাকার, বাদামি রঙের, শাঁস সাদা, কচকচে এবং খুব মিষ্টি (ব্রিক্সামান ২০-২৫%)। খাদ্যোপযোগী অংশ ৫৫-৬০%। বাংলাদেশের সব এলাকায় চাষযোগ্য। হেক্টরপ্রতি ফলন ৩-৪ টন।

বারি আঁশফল-২ উচ্চফলনশীল নিয়মিত ফলদানকারী জাত। গাছ খাটো, ছড়ানো ও অত্যধিক ঝোপাল। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে গাছে ফুল আসে এবং শ্রাবণ মাসের শেষার্ধে ফল আহরণ উপযোগী হয়। ফল তুলনামূলকভাবে বড় (৯.০ গ্রাম), বাদামি রঙের, শাঁস সাদা, কচকচে এবং খুব মিষ্টি (ব্রিক্সমান ২৫%)। বীজ খুব ছোট, খোসা পাতলা, খাদ্যোপযোগী অংশ ৭৩%। বাংলাদেশের সব এলাকায় চাষযোগ্য। হেক্টরপ্রতি ফলন ৮-১০ টন।

বংশবিস্তার

বীজ থেকে সহজেই চারা তৈরি করা যায়। বীজ থেকে উৎপাদিত গাছ হুবহু মাতৃ গুণাগুণ বহন করে না এবং ফল ধরতে দীর্ঘ সময় (৭-৮ বছর) লাগে। অঙ্গজ বংশবিস্তারই আঁশফলের জন্য অনুমোদিত বংশবিস্তার পদ্ধতি। গুটি কলম হচ্ছে অঙ্গজ বংশবিস্তারের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রচলিত পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সফলতার হার বেশি (৮০-৯০%)। তবে গুটিকলমের মাধ্যমে তৈরি গাছের শিকড়ের বিস্তার কম থাকায় এবং প্রধান মূল নাথাকায় সহজেই বাতাসে উপড়ে যায়।

অপরদিকে একটি গাছ হতে অল্প কয়েকটি গুটি কলম করা যায়। তাই গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে চারা তৈরি করা উত্তম। সাধারণত ৮-১২ মাস বয়সের আঁশফলের চারা রুটস্টক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মে-জুন মাসে কাক্সিক্ষত মাতৃগাছ হতে ৪-৫ মাস বয়স্ক সায়ন সংগ্রহ করে ফাটল (Cleft grafting) পদ্ধতিতে জোড়া লাগানো হলে সফলতা ও কলমের বৃদ্ধি ভালো হয় এবং এ পদ্ধতিতে উৎপন্ন কলম হতে ৩-৪ বছরে ফল পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন   করলার চাষ পদ্ধতি


উৎপাদন কলাকৌশল

জমি নির্বাচন ও তৈরি : আঁশফল চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি উত্তম। জমি নির্বাচন করে চাষ ও মই দিয়ে এবং দীর্ঘজীবী আগাছা সমূলে অপসারণ করে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে।

চারা-কলম নির্বাচন : রোপণের জন্য এক বছর বয়স্ক সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত কলমের চারা নির্বাচন করতে হয়।

রোপণ পদ্ধতি : সমতল ভূমিতে বর্গাকার বা আয়তকার বা ষড়ভূজি পদ্ধতিতে চারা রোপণ করা যেতে পারে। কিন্তু উঁচু নিচু পাহাড়ি এলাকায় কন্টুর রোপণ পদ্ধতিতে চারা রোপণ করা উত্তম।

রোপণের সময় : জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় এবং ভাদ্র-আশ্বিন মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে পানি সেচের সুব্যবস্থা থাকলে সারা বছরই আঁশফলের চারা-কলম রোপণ করা চলে।

গর্ত তৈরি : চারা রোপণের ১৫-২০ পূর্বে ৫ মি. x ৫ মি. দূরত্বে ১ মি. x১ মি. x১ মি. আকারের গর্ত করতে হবে। গর্তের উপরের মাটির সাথে ১৫-২০ কেজি জৈবসার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি ও ২৫০ গ্রাম এমওপি সার ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে তাতে পানি দিতে হবে।

চারা-কলম রোপণ ও পরিচর্যা : গর্তে সার প্রয়োগের ১০-১৫ দিন পর গর্তের মাঝখানে নির্বাচিত চারাটি খাঁড়াভাবে রোপণ করে চারার চারদিকের মাটি হাত দিয়ে চেপে ভালোভাবে বসিয়ে দিতে হয়। চারা রোপণের পর শক্ত খুঁট পুঁতে খুঁটির সঙ্গে চারাটি বেঁধে দিতে হবে যাতে বাতাসে চারার কোনো ক্ষতি না হয়। প্রয়োজনবোধে বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। চারা রোপণের পরপরই পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।

গাছে সার প্রয়োগ : গুণগতমানসম্পন্ন উচ্চফলন পেতে হলে আঁশফলে নিয়মিত সারপ্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। গাছের বয়স বাড়ার সঙ্গে সারের পরিমাণও বাড়াতে হবে। নিম্নের ছকে গাছের বয়সভিত্তিক সারের পরিমাণ দেয়া হলো। উল্লিখিত সার তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হয়। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে ফল সংগ্রহের পর ১ম বার, ফাল্গুন-চৈত্র মাসে মুকুল আসার সময় ২য় বার এবং জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে বীজের রঙ ধারণপর্যায়ে ৩য় বার সার প্রয়োগ করতে হয়।

আরও পড়ুন   থাই পেয়ারা চাষ পদ্ধতি

পোকামাকড় ও রোগবালাই

আঁশফলে তেমন কোনো পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ হতে দেখা যায় না। তবে ফলের পরিপক্ব পর্যায়ে পাখি (ফিঙে, দোয়েল) ও বাদুড় ফল খেয়ে প্রচুর ফল নষ্ট করে ফেলে। তাই প্রত্যেক গাছ আলাদাভাবে বা সম্পূর্ণ বাগানে নাইলন নেট দিয়ে আবৃত করে ফল রক্ষা করা যায়।

কালো পিপড়া : এ ফল বেশি মিষ্টি বিধায় গাছে থাকা অবস্থায় কালো পিঁপড়া বীজ ও খোসা বাদ দিয়ে ফলের সব শাঁস খেয়ে ফেলে।

দমন ব্যবস্থা : বাগানের আশপাশে পিঁপড়ার বাসা থাকলে তা ধ্বংস করে ফেলতে হবে। সেজন্য মাটিতে ডারসবান ২০ ইসি @ ২ মিলিলিটার বা লরসবান ১৫ জি ৫ গ্রাম/লিটার হারে প্রয়োগ করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে গাছে ক্লোরপাইরিফস ২০ ইসি বা ডারসবান ২০ ইসি ১.৫ মিলিলিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। ফল সংগ্রহের অন্তত ১৫ দিন পূর্বে অবশ্যই কীটনাশক প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।

ফল সংগ্রহ

ফাল্গুন-চৈত্র (মার্চ) মাসে ফুল আসে এবং শ্রাবণ-ভাদ্র (আগস্ট) মাসে ফল পাকে। সম্পূর্ণ পাকার পর ফল গাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয়। আবার ফল বেশি পেকে গেলে গাছ থেকে ঝরে পড়ে ও ফেটে যায়, যা গাছের ফলনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। তাই সময়মতো ফল সংগ্রহ আঁশফলের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ড. মো. মসিউর রহমান*

*ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর,

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে দিন

Comments are closed.

© All rights reserved © 2014 Ajkerkrishi.com
Developed By One Planet Web