আজ শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:১৯ পূর্বাহ্ন
পাটি গাছ চাষ পদ্ধতি
পাটি গাছ হচ্ছে বাংলাদেশের একটি অর্থকরী জাতীয় সম্পদ। পাটি গাছ দেখতে নলের মতো। তবে এ গাছ নলের মত শক্ত ও লম্বা হয় না। এর পাতা হলুদের পাতার মত দেখতে তবে আকৃতি হলুদের পাতা থেকে একটু ছোট। কৃষি জমি বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামাঞ্চলে পাটি গাছের চাষ অনেক কমে গেছে। এখন আমাদের দেশে সামান্য এলাকায় পাটি গাছের সীমিত আবাদ হচ্ছে। বর্তমানে পাটি গাছ গ্রামীণ আবাদী ফসল হিসেবে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নাটোর, দিনাজপুর, বরিশাল ও মুন্সীগঞ্জে চাষ করা হচ্ছে। তবে ইদানিং আমাদের দেশের অনেক স্থানে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ও লাভজনকভাবে পাটি গাছ চাষ হচ্ছে। একজন বেকার নারী বা পুরুষ নিজের কর্মসংস্থান ব্যবস্থার জন্য নিজের জমিতে অথবা বর্গা নেয়া জমিতে পাটি গাছ চাষ করে ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
বাজার সম্ভাবনা
পাটি গাছের অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। পাটি গাছের প্রধান শিল্পদ্রব্য হলো শীতল পাটি। পাটি গাছের কান্ড থেকে কাগজ তৈরি করা হয়। এছাড়া পাটি গাছ দিয়ে জায়নামাজ, খেলনা, ব্যাগ, ম্যানিব্যাগ, কুশন, ওয়ালম্যাট, ফুলদানি, কলমদানি, ফুলের সাজি, বাক্স, ছবির ফ্রেম, আয়নার ফ্রেম, টেবিল ল্যাম্প ইত্যাদি তৈরি করা হয়। দেশে অবস্থিত বিভিন্ন কারু ও হস্তশিল্পজাত দ্রব্যের দোকানগুলোতে এর অনেক চাহিদা আছে। এছাড়া শীতলপাটি এবং এইসব পাটি গাছ জাত হস্তশিল্প বিদেশে রপ্তানি করেও আয় করা সম্ভব।
পাটি গাছ উৎপাদন কৌশল
চাষের উপযোগী পরিবেশ ও মাটি
জলবায়ু মাটির প্রকৃতি
চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও কার্তিক মাস পাটি গাছ চাষের জন্য উপযুক্ত সময়। যে সব জমিতে প্রয়োজনীয় ফসল ভালো জন্মায় না বা আবাদ করা লাভজনক নয় এরকম জায়গায় পাটি গাছ চাষ করতে হবে। এছাড়া প্রায়ই পানি জমে থাকে এবং শুকনা মৌসুমেও মাটি ভেজা বা স্যাঁতস্যাঁতে থাকে এরকম জায়গায় পাটি গাছ ভালো জন্মে।
পাটি গাছ চাষ পদ্ধতি
৩ পদ্ধতিতে পাটি গাছ চাষ করা যায়। যেমন:
1. মোথা থেকে চাষ
2. শাখা থেকে চাষ
3. বীজ থেকে চাষ
• মোথা থেকে চাষ
পাটি গাছের মাটির নিচে অবস্থিত শেকড়সহ মোথা অন্য জায়গায় রোপণের মাধ্যমে বংশবিস্তার করা যায়। মোথা রোপণের ৩টি পর্যায় আছে।
• মোথা সংগ্রহ
• রোপণের জমি তৈরি
• জমিতে মোথা রোপণ
1. সাধারণত চৈত্র ও বৈশাখ মাসে পাটি গাছের ঝাড় বা বন থেকে পাটি গাছের কান্ড জোগাড় করতে হবে।
2. কান্ড জোগাড়ের সময় ঝাড় থেকে মাটি খুঁড়ে যে কয়টি মোথা প্রয়োজন তা সংগ্রহ করতে হবে।
1. পাটি গাছ চাষের নির্বাচিত জমি থেকে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
2. আগাছা পরিষ্কার করার পর মাটি চাষ করে জমি তৈরি করে নিতে হবে।
1. মোথা সংগ্রহের পরপরই তা জমিতে রোপণ করতে হবে।
2. জোগাড় করা মোথা সারিতে রোপণ করতে হবে।
3. রোপণের সময় সারি থেকে সারি এবং মোথা থেকে মোথার দুরত্ব ২ ফুট রাখতে হবে।
• শাখা থেকে চাষ
পাটি গাছের অন্তত ১টি গিঁটযুক্ত শাখা বা ডাল এবং প্রশাখা থেকে অন্য জায়গায় বংশবিস্তার করা সম্ভব। শাখা থেকে চাষ করার তিনটি পর্যায় আছে।
• শাখা সংগ্রহ
1. পাটি গাছ চাষের সময়ে ঝাড় থেকে শাখা কেটে সংগ্রহ করতে হবে।
2. বর্ষার সময় ঝাড় থেকে শাখা কাটার মাধ্যমেও দন্ডায়মান ঝাড় থেকে শাখা সংগ্রহ করা যেতে পারে।
3. একটি শাখাতে গিঁটসহ ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি লম্বা কান্ড ধারালো ছুরি দিয়ে কাটতে হবে।
• জমিতে শাখা রোপণ
1. কাটা শাখা পানিতে ডুবিয়ে ২ থেকে ৩দিন মজুদ রাখা যায়।
2. শাখা কেটে সংগ্রহের পর পরই নির্বাচিত জমিতে সারিতে শাখাগুলো রোপণ করতে হবে।
3. মাটিতে শাখা রোপণের সময় গিঁটযু্ক্ত অংশ মাটিতে পুঁতে দিতে হবে। কারণ গিঁট থেকেই শেকড় গজাবে।
4. শাখা চারা রোপণের সময় সারি থেকে সারি ও চারা থেকে চারার দূরত্ব ২ ফুট রাখতে হবে।
5. বর্ষাকালে শাখা কেটে রোপণ করলে বেঁচে উঠার হার বেশি হবে।
• বীজ থেকে চাষ
বীজ থেকে চারা তৈরির মাধ্যমে ঝাড়ের ক্ষতি রোধ করা যায়। তবে বীজ থেকে উৎপন্ন চারা দিয়ে সম্পূর্ণ ঝাড় ও মোটা কান্ড তৈরি করতে বেশ সময় লাগে। এর কয়েকটি ধাপ আছে।
• বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
1. পাটি গাছের ঝাড়ে মাঘ-ফাল্গুন মাসে ফুল ফোটে ও চৈত্র-বৈশাখ মাসে ফল পাকে।
2. ফল পাকার সময় বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
3. ফলের রঙ হালকা হলুদ হলে বুঝতে হবে ফল পেকে গেছে।
4. একটি ফলে ১ থেকে ৩টি বীজ থাকে। এক কেজিতে ১৭০০-২০০০টি শুকনো ফল হতে পারে।
5. পাকা ফল থেকে বীজ আলাদা করে নিয়ে শুকনো পাত্রে ও কম তাপমাত্রায় বীজ সংরক্ষণ করতে হবে।
6. বীজ জোগাড় করার সাথে সাথে সরাসরি বীজতলাতে রোপণ করা সবচেয়ে ভালো।
• বীজতলা তৈরি
1. বীজ থেকে ছোট চারা উৎপন্ন করার জন্য ছায়া ও সারযুক্ত মাটিতে বীজতলা তৈরি করা হয়।
2. বীজতলাতে তিন ভাগ দো-আঁশ মাটি ১ ভাগ গোবরের মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়।
3. এছাড়া ভেজা কাঠের ভুষি অথবা সমান পরিমাণ ভেজা ভুষি ও বালু মিশিয়েও বীজতলা তৈরি করা যায়।
• বীজ বপন
• পলিব্যাগে চারা স্থানান্তর
1. পাটি গাছের বীজতলাতে সরাসরি বীজ বপন না করে জোগাড় করা পাকা ফল রোপণ করতে হবে।
2. ফল সংগ্রহের পরপরই ফল রোপণ করা ভালো।
3. বীজতলাতে ফল রোপণে ২০-২৫ দিনের মধ্যেই বীজ থেকে চারা গজাতে শুরু করে।
4. এক থেকে দেড় মাস ধরে চারা গজাতে থাকে। গজানো চারা প্রায় ১ বছর বীজতলাতে লালন করে তারপর অন্য জায়গায় রোপণ করতে হবে।
1. পলিব্যাগে স্থানান্তর ছাড়াই চারা জমিতে রোপণ করা যায়। তবে চারার মৃত্যুর হার কমানোর জন্য পলিব্যাগে চারা স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়।
2. চারা গজানোর পর বীজ থেকে চারা তুলে মাটি ও গোবর ৩:১ অনুপাতে মিশিয়ে ৬²´৯² মাপের পলিব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে।
3. একটি ফল থেকে এক জায়গায় ২-৩টি চারা গজায়। তাই পলিব্যাগে স্থানান্তর সময় চারাগুলোতে আলাদা করে আলাদা পলিব্যাগে রোপণ করতে হবে।
4. এর ফলে চারার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
5. পলিব্যাগে চারা প্রায় ১ বছর রেখে চারাগুলো একটু বড় ও শক্ত করে নিতে হবে।
• রোপণের জমি তৈরি
• জমিতে চারা রোপণ
সার প্রয়োগ:
কৃষকদের মতে গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে পাটি গাছ চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরণ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে। বাড়িতে গবাদি পশু থাকলে সেখান থেকে গোবর সংগ্রহ করা যাবে। নিজের গবাদি পশু না থাকলে পাড়া-প্রতিবেশি যারা গবাদি পশু পালন করে তাদের কাছ থেকে গোবর সংগ্রহ করা যেতে পারে। এছাড়া ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে আবর্জনা পচা সার ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়ির আশে-পাশে গর্ত করে সেখানে আবর্জনা, ঝরা পাতা ইত্যাদি স্তুপ করে রেখে আবর্জনা পচা সার তৈরি করা সম্ভব।
রোগবালাই:
যেখানেই পাটি গাছের ঝাড় সৃষ্টি হয় সেখানেই এক ধরণের আরোহী লতা (জার্মান লতা) বৃদ্ধি পেয়ে সমস্ত ঝাড়কে ছেয়ে ফেলে এবং পাটি গাছকে বাড়তে দেয় না।
প্রতিকার:
প্রতিবছর ঝাড়কে আগাছামুক্ত করতে হবে এবং আরোহী লতা যেন সৃষ্টি না হয় সেজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। পাটি গাছে তেমন রোগের লক্ষণ দেখা যায় না। তাই এটি চাষে রোগবালাই প্রতিরোধের ঝামেলা নেই বললেই চলে। তবে পাটি গাছ চাষের জমিতে পোকার আক্রমণ হলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে পোকা দমন না হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা অফিসে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে।
চাষের সময়ে পরিচর্যা:
সাবধানতা:
ফসল সংগ্রহ:
পাটি গাছ লাগানোর ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যেই ফসল বা কান্ড কাটা যায়। তারপর প্রতিবছরই ফসল বা কান্ড কাটা যায়। সাধারণত চৈত্র মাস থেকে শুরু করে বৈশাখ মাস পর্যন্ত সময়ে পাটি গাছের কান্ড আহরণ করা ভালো।
পাটি গাছ উৎপাদন খরচ:
• ১বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে ফসল উৎপাদন খরচ
খরচের খাত পরিমাণ আনুমানিক মূল্য (টাকা)
বীজ/চারা ২০০ টি মোথা ১০০০
জমি তৈরি ৩-৪ বার ১১৫০
শ্রমিক ২ জন ৫০০
সার প্রয়োজন অনুসারে জৈব সার
এই সার বাড়িতেই তৈরি করা সম্ভব। তাই এর জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন নেই।
কীটনাশক প্রয়োজন অনুসারে জৈব বা রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার নিজস্ব/দোকান
জমি ভাড়া একবছর ৪০০০
মাটির জৈব গুণাগুণ রক্ষা ও উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য জৈব সার ও জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে লাভের পরিমাণ বাড়তে পারে।
মূলধন
এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে পাটি গাছ চাষের জন্য প্রায় ৩০০০ টাকার প্রয়োজন হবে। মূলধন সংগ্রহের জন্য ঋণের প্রয়োজন হলে নিকট আত্মীয়স্বজন, সরকারি ও বেসরকারি ঋণদানকারী ব্যাংক(সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক , রূপালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক) বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও)-এর সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এসব সরকারি ও বেসরকারি ঋণদানকারী ব্যাংক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (আশা, গ্রামীণ ব্যাংক, ব্রাক, প্রশিকা) শর্ত সাপেক্ষে ঋণ দিয়ে থাকে।
প্রশিক্ষণ:
পাটি গাছ চাষের আগে অভিজ্ঞ কারও কাছ থেকে এ চাষের বিস্তারিত জেনে নিতে হবে। এছাড়া চাষ সংক্রান্ত কোন তথ্য জানতে হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্ধারিত ফি এর বিনিময়ে কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
পাটি গাছ বাংলাদেশের একটি অর্থকরী জাতীয় সম্পদ। পাটি গাছ দিয়ে বিভিন্ন সৌখিন দ্রব্য তৈরি করা যায়। তাই পাটি গাছ চাষ করে বাড়তি আয় করা সম্ভব।
ছবি সূত্র- গুগল। তথ্য- ইন্টারনেট।